লিফলেট বিতরণ করলেই গ্রেফতার করা হবে। পোস্টার ছাপতে দেওয়া যাবে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে মাইক ব্যবহার করা চলবে না। অর্থাৎ ‘কোলাহল বারণ’ হয়েছে। সুতরাং মানুষের সঙ্গে ‘এ বার কথা কানে কানে’। বাংলাদেশের জেলা উপজেলায় এই কৌশলই ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজের গোপন ডেরা থেকে ফোনে জানালেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাক্তন সাংসদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিম। শেখ হাসিনার সহকারী এই নেতাই আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক পেজ থেকে বিবৃতি দিচ্ছেন দলের এই আপৎকালীন সময়ে।
নাছিমের কথায়, ‘‘দলের সভাপতি শেখ হাসিনা দেশের বাইরে নয়াদিল্লিতে আছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন নন। দলের কর্মী-নেতা, বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলছেন। কখনও বিবৃতি দিচ্ছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অর্থনৈতিক কষ্টের কথা শুনছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন। নেত্রী জানেন যে এখন দেশে আইনের শাসন নেই। অধিকাংশ নেতা কারাগারে। আমরা অনেকেই আত্মগোপন করে রয়েছি। কিন্তু তার মধ্যেই গণবিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছেন নেত্রী।’’
কেমন হবে সেই গণবিস্ফোরণের মডেল? চলতি পরিস্থিতিতে রাতারাতি হওয়া তো অসম্ভব। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দাবি, হাসিনার নির্দেশে সেই লক্ষ্যে ধীরে ধীরে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রতিটি গ্রামে তৃণমূল স্তরের মানুষ যাঁরা দুরবস্থার শিকার, যে সব সংখ্যালঘু নিপীড়নের মধ্যে রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে নিভৃতে যোগাযোগ করছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা। নাছিমের কথায়, ‘‘মানুষকে জাগ্রত করা, সচেতন করার জন্য আরও বড় করে চেষ্টা শুরু হবে। বড় মানে ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়, সেটা সম্ভবও নয় এই পরিস্থিতিতে। ইতিমধ্যেই আমরা সমাজমাধ্যমে প্রচার করে চলেছি। ভুললে চলবে না, এখনও সাধারণ মানুষের মধ্যে আমাদের ৪০ শতাংশ ভোটার রয়েছে। আত্মগোপন বা বন্দিদশার বাইরেও পঁচিশ শতাংশ কর্মী-সমর্থক রয়েছেন। তাঁরা মানুষের কানে কানে কথা বলবেন। ইশারায় কথা হবে।
আরও বেশি করে সমাজমাধ্যম ব্যবহার করা হবে।’’
আওয়ামী লীগ শীর্ষ সূত্রে জানানো হচ্ছে, সুযোগসুবিধা মতো জেলা-উপজেলা-গ্রামের দিকে মিছিল করা হবে। সেই মিছিলের দৈর্ঘ্য ক্রমশ বাড়বে বলেই আশা করছেন তাঁরা। শেখ হাসিনার নির্দেশ, এই সংযোগের ভিত্তিতে জনমত তৈরি করে পরবর্তী কালে তাকে ‘জনবিস্ফোরণে’ পরিণত করতে হবে। তাঁর আশা, ইতিহাসে এমন এক একটা সময় বা পরিস্থিতি আসে, বিস্ফোরণের জন্য বেশি সময় লাগে না। বাংলাদেশে তা আগেও ঘটেছে। আবারও ঘটবে।
প্রসঙ্গত গত ২০ তারিখ আওয়ামী লীগের কাছে খবর ছিল, সে দেশের ট্রাইবুনাল হাসিনার বিরুদ্ধে খুন-গণহত্যার চার্জশিট দেবে। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ মিছিল করতে পেরেছিলেন দলের কর্মী-সমর্থকরা। রাজধানী ঢাকায় আচমকাই আওয়ামী লীগ, যুব লীগ ও অধুনা-নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের মিছিল বার হয়। বিষয়টিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য’ বলেই অভিহিত করছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। আশা করছেন, এই মিছিল আগামী দিনে সর্বাত্মক হবে এবং বহরে বাড়বে। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটবে। আপাতত বিশ্বের যেখানে সম্ভব, বাংলাদেশ হাই কমিশনে সেই দেশের আওয়ামী লীগ সমর্থক-কর্মীরা বর্তমান সঙ্কটের নিরসন চেয়ে স্মারকলিপি জমা দেওয়া শুরু করেছেন।
অন্য দিকে, নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের সম্ভাবনা উস্কে দিয়ে সম্প্রতি বিএনপি-র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে লন্ডনে সাক্ষাৎ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান এবং নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। লন্ডনে খালেদা জিয়ার পুত্র তথা বিএনপি-র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের বাড়িতে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। তারেকও উপস্থিত ছিলেন। এর পর দেশে ফিরে বিএনপি-র সুরে সুর মিলিয়ে আগামী রমজানের আগে নির্বাচন ঘোষণার দাবি তোলেন জামায়েতের আমির। কী ভাবে গোটা বিষয়টিকে দেখছে আওয়ামী লীগ?
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের কথায়, জামায়াতে এবং মুহাম্মদ ইউনূসের হিসাব হয়তো গোড়ায় একই ছিল। খিলাফৎ এবং মৌলবাদী সংগঠনগুলিরও আশা ছিল ক্ষমতা দখলের। কিন্তু এখন তো স্পষ্ট, তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। কেননা ইউনূস ক্ষমতা ছাড়তে চান না। আট মাস হয়ে গেল এখনও তিনি নির্বাচনের পথনির্দেশিকা দিচ্ছেন না। ফলে এখন জামাত আর বিএনপি অভিন্ন স্বার্থে একজোট হতে চাইছে। তারা পুরনো মিত্রও বটে। আওয়ামী লীগ এদের মূল নিশানা। তারা চায় আওয়ামী লীগকে ভোট থেকে সরিয়ে দিতে।
নাছিমের কথায়, ‘‘দেশবাসী বুঝতে পারছেন, বিপ্লবের নামে বিদেশি শক্তির ইন্ধনে ডলার এনে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছে এই উপদেষ্টা সরকার। তরুণ সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করতে চাইছে।’’ আওয়ামী লীগের দাবি, যে গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছিল, আজ সেই চেতনা হটিয়ে তাকে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নামে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী অস্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)