জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি)-তে নাম তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। অনেক দিন ধরেই চলছে নথিপত্র সংগ্রহের ঝামেলা। তা এখনও শেষ হয়নি। এখনও অনেকে জানেন না তাঁর নাম আদৌ এনআরসি-তে থাকবে কি না। না থাকলে কী হবে, সে প্রশ্নেরও উত্তর জানা নেই।
এমনই পরিস্থিতির মধ্যে শুরু হয়েছে আবেদনপত্র বিলির কাজ। যাঁরা আবেদনপত্র হাতে পেয়ে গিয়েছেন, তাঁদের কাছে নতুন সমস্যা— সেটি পূরণ করবেন কী ভাবে। দু’দিন থেকে অফিস, চায়ের দোকান, বাসস্ট্যান্ডে একই চর্চা।
আবেদনপত্র পূরণ করা নিয়ে সঙ্কটে পড়েছেন গ্রাম-শহরের অধিকাংশ মানুষ। স্বল্পশিক্ষিতরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। উচ্চশিক্ষিতরাও হিমসিম খাচ্ছেন। আবেদনপত্রে অনেক তথ্য চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সরাসরি জবাব চাওয়া হয়নি। অধিকাংশ জবাব ‘কোড নম্বর’ দিয়ে বোঝাতে হবে।
প্রশাসনিক সূত্রে তেমন কয়েকটি উদাহরণও মিলেছে। যেমন, গৃহকর্তার সঙ্গে সম্পর্কের জায়গায় স্ত্রীকে ‘স্ত্রী’ লিখলে চলবে না, লিখতে হবে ২। ছেলেমেয়েদের ৩, নাতি-নাতনিদের ক্ষেত্রে ৪ লিখতে হবে। জন্মের তারিখ যেমন চাওয়া হয়েছে, তেমন ১ এপ্রিল ২০১৫-কে ধরে বর্তমান বয়স উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। অনেকের কাছে তা কঠিন অঙ্ক।
‘লিগ্যাসি ডেটা কোড’ ব্যবহার, ফোটো লাগানো নিয়ে নানা নির্দেশেও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। খোদ জেলাশাসকের অফিসের এক কর্মীর মন্তব্য, ‘‘এ যেন স্টাফ সিলেকশন কমিশনের পরীক্ষা।’’ ইটখলা বাজারের এক ব্যবসায়ী নিজের দোকানে বসে আবেদনপত্রটি পড়ছিলেন। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সঙ্গে দেওয়া নির্দেশিকা পড়েন। কিছুক্ষণ পর সব সরিয়ে রেখে বলেন, ‘‘আবেদন পত্রের চেয়েও কঠিন নির্দেশিকাটিই।’’ অথচ সেটির উপরে লেখা রয়েছে— ‘রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জী উন্নীতকরণ আবেদনপত্র পূরণ করার সহজ উপায়।’
সাধারণ মানুষ আবেদনপত্র নিয়ে এর তার কাছে ছুটছেন। বলা হয়েছে, ওই আবেদনপত্রে কোনও কাটাকুটি করা চলবে না। সামান্য ত্রুটিতে ফর্ম বাতিল হয়ে যাবে! এই সুযোগে ফর্ম পূরণের জন্য দালালরা এগিয়ে এসেছে। সে জন্য মর্জিমাফিক দর হাঁকছে তাঁরা।
পালংঘাটের ‘শিবদুর্গা ক্লাব’ ওই এলাকায় এনআরসি ফর্ম পূরণের শিবির করে। কী ভাবে আবেদন পত্র পূরণ করতে হবে, তা এলাকাবাসীকে বোঝানোর জন্য আইনজীবী ধর্মানন্দ দেবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। গত রবিবার পুনিছড়া বাগানের নাচঘরে সেই শিবির ও সচেতনতা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ক্লাব-কর্তা লালনপ্রসাদ গোয়ালার বক্তব্যের পর মূল আলোচনা শুরু হয়। ধর্মানন্দবাবু জানান, কারও যদি জন্মের দিন-তারিখ জানা না থাকে, তা হলে আবেদনপত্রে ৩ (ক) নম্বর কলাম ফাঁকা রেখে দিলে হবে। পরে ৩ (খ)-তে শুধু বছরের ঘরে আনুমানিক বয়স লিখে দেবেন। আবেদনপত্র পূরণে কালো কালির পেন ব্যবহার করতে হবে। ছবি লাগাতে গিয়ে পিন ব্যবহার করা চলবে না। আঁঠা দিয়ে তা সাঁটতে হবে। আইনজীবী জ্যোতির্ময় নাথও ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। শিবদুর্গা ক্লাবের সম্পাদক মিলনপ্রসাদ গোয়ালা বলেন, ‘‘এই ধরনের আরও সভা করলে উপকার মিলবে।’’
কাছাড়ের জেলাশাসক এস বিশ্বনাথন বলেন, ‘‘কাজের সুবিধার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নদিন আবেদন পত্র জমা দিতে বলা হচ্ছে। তা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ অবশ্য ৩১ জুলাই।’’ আবেদনপত্রের জটিলতা নিয়ে তাঁর জবাব, ‘‘এই কাজ সুপ্রিম কোর্টের প্রত্যক্ষ তদারকি ও তত্ত্বাবধানে চলছে। আমরা শুধু নির্দিষ্ট ভাবে বেঁধে দেওয়া নিয়মনীতি পালন করছি।’’ তিনি আরও জানান, বাড়ি বাড়ি আবেদনপত্র পাঠানো হচ্ছে। কেউ কোনও কারণে তা না পেলে নির্দিষ্ট সেবাকেন্দ্রে গিয়ে যোগাযোগ করতে পারবেন। সেখানেও আবেদনপত্র রাখা হয়েছে।
এ দিকে, নাগরিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি (সিআরপিসি)-র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জীর উপর ভিত্তি করে এখন নবীকরণের কাজ চলছে। কিন্তু ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জী ভুলে ভরা এবং অসম্পূর্ণ। এ প্রসঙ্গে কমিটির সভাপতি নৃপেন্দ্র চন্দ্র সাহা, প্রধান সম্পাদক সাধন পুরকায়স্থ ও সাধারণ সম্পাদক বিধান দাস পুরকায়স্থ হাইকোর্টের ১৯৬৭ সালের একটি রায়ের উল্লেখ করেন। তৎকালীন আসাম-নাগাল্যান্ড হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পি কে গোস্বামী ওই রায়ে বলেছিলেন, ‘১৯৫১ সালের এনআরসি গোপন নথি। একে প্রকাশ্যে আনা যায় না। ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের ৭৪ নম্বর ধারাতেও আসে না এই নথি।... সেন্সাস আধিকারিকদের তৈরি করা একটি সাময়িক নথি হল এনআরসি। জনগণনার আধারে তৈরি করা হয়েছিল সেটি। সেন্সাস আইনের ১৫ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, এর কোনও তথ্য সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।’
১৯৭০ সালের আসাম-নাগাল্যান্ড ইন্ডিয়ান ল’ রিপোর্টেও এই রায়ের উল্লেখ রয়েছে বলে নৃপেন্দ্রবাবুরা জানান। সিআরপিসি নেতাদের বক্তব্য, ১৯৫১ সালের এনআরসি-তে প্রচুর ভুলত্রুটি রয়েছে। তাই সেটি কখনও ভিত্তি হতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy