আলোর সাজে ধরদোর উৎসব আঙিনা। — নিজস্ব চিত্র
কলকাতা থেকে আগমন শুনে থমকালেন গুজরাত সরকারের পর্যটন দফতরের কর্তাটি। তারপর বললেন, ‘‘বাংলায় এত দেখার জিনিস, অথচ পর্যটনের কী হাল সেখানে!’’
ভদ্রলোক বছরখানেক আগে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন। বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার মন্দিরও দেখতে যান। এবং ফেরেন একরাশ হতাশা নিয়ে। বললেন, ‘‘ওই রকম ‘হেরিটেজ’ মন্দির। অথচ তাকে ঘিরে ঠিকঠাক একটা হোটেল নেই। আধুনিক বিনোদন নেই। লোকে তো শুধু মন্দির দেখতে যাবে না! এটা বুঝতে হবে।’’
আপনারা বুঝেছেন?
পোড়খাওয়া অফিসার এ বার হেসে ফেললেন। বললেন, ‘‘এই সত্যিটা না বুঝলে কি আর আদিগন্ত নোনা বালির ‘সাদা রণ’-এ এমন আন্তর্জাতিক উৎসব করতে পারতাম? তা-ও আবার তিন মাস ধরে?’’
কচ্ছের এই রণ পৃথিবীর বৃহত্তম মরসুমি জলাভূমি। গুজরাতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তান সীমান্তঘেঁষা এই এলাকাটা গোটা বর্ষাকাল থাকে জলের তলায়। কিন্তু মাঝ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সেখানেই তাকলাগানো এক দুনিয়া। এ দুনিয়া ‘রণ-উৎসবের’!
শুরু ২০০৬ সালে। নরেন্দ্র মোদী তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। গোড়ায় এই উৎসব হতো মাত্র তিন দিনের। সরকারি প্রচেষ্টায় বহর থেকে ব্যাপ্তি সবই বেড়েছে। রণ-উৎসব এখন গুজরাত সরকারের পর্যটনের মুখ।
সব থেকে বড় আকর্ষণ, স্রেফ তাঁবুর অস্থায়ী শহর। রণ-এর ধরদো এলাকাতেই বসে উৎসবের আসর। সার সার তাঁবুতে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা। সাজানো খাট-বিছানা, এসি, রুম হিটার, লাগোয়া বাথরুমে গরম জল থেকে প্রসাধনী সব রয়েছে। ডাইনিং হলে খাওয়ার আয়োজনও এলাহি। গুজরাতি নিরামিষ খানা থেকে রকমারি স্যুপ, হরেক মিষ্টি। সোজা হিসেব— আরামে থাকো, খাও-দাও আর দু’চোখ ভরে দেখো! দেখে নাও, সূর্যোদয়, সূর্যাস্তে রং বদলের খেলা আর পূর্ণিমার রাতে সাদা বালুতে জোছনার লুটোপুটি।
কিন্তু ভোর, সন্ধে আর চাঁদনি রাত বাদে দু’রাত-তিন দিনের প্যাকেজ ট্যুরে বাকি সময়টায় কী করবেন পর্যটকেরা? যদি একঘেয়ে লাগে? সেই কথা ভেবেই উৎসব প্রাঙ্গণে নানা বিনোদনের বন্দোবস্ত। প্যারাগ্লাইডিং, স্পা, লাইব্রেরি, মিউজিয়াম থেকে গুজরাতি হস্তশিল্পের স্টল। সেখানে মিলবে জামাকাপড় থেকে ঘর সাজানোর টুকিটাকি, ঝিনুকের সামগ্রী, রুপোর গয়না। সঙ্গে খাঁটি গুজরাতি নাচ-গান।
গুজরাতের পর্যটনমন্ত্রী সৌরভ পটেল জানালেন, প্রথমেই পরিকাঠামোয় নজর দিয়েছিলেন তাঁরা। যেমন— দুর্গম এই এলাকা পর্যন্ত রাস্তা তৈরি, নর্মদার জল নিয়ে আসা, বিদ্যুতের সাব স্টেশন তৈরি। আগে উৎসবের আয়োজন পর্যটন বিভাগই করত। কয়েক বছর হল তিন মাসের জন্য টেন্ডার ডেকে এলাকাটা লিজ দেওয়া হয়। তবে কিছু তাঁবু আর কটেজ রয়েছে পঞ্চায়েতের হাতে। সেখান থেকে সরাসরি আয় হয় সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের। পর্যটনমন্ত্রীর কথায়, ‘‘একটা শুখা এলাকা, যেখানে চাষ নেই, সেখানকার অর্থনীতিটাই বদলে দিতে চাই আমরা।’’
এবং সেটা হচ্ছেও। পর্যটন উৎসবের হাত ধরে স্থানীয় অর্থনীতিতে বদল আসছে দ্রুত। আশপাশের গ্রামে শুরু হয়েছে ‘হোম স্টে’। বাড়ির চৌহদ্দিতেই ছিমছাম কটেজ বানিয়েছেন অনেকে। উট-মোষ-ছাগল চরিয়ে দিন গুজরান করা মানুষগুলো কটেজ পিছু দৈনিক তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা রোজগারও করছেন। এবং এর জন্য সরকার কোনও বাণিজ্য-কর নিচ্ছে না!
হোডকো গ্রামে প্রৌঢ়া বায়া বাঈয়ের বাড়ি-লাগোয়া কটেজে তো থেকে গিয়েছেন খোদ অমিতাভ বচ্চন। মনে পড়ে সেই ‘কুছ দিন তো গুজারিয়ে গুজরাত মে’ বিজ্ঞাপনগুলো? ‘বিগ বি-র কটেজ’ দেখতেও বহু
পর্যটক আসেন এই গ্রামে। যেমন এসেছিলেন ইতালীয় দম্পতি আলবার্তো ব্রুনো এবং ভিত্তোরিয়া। দ্বারকা, সোমনাথ, পোরবন্দর ঘুরে রণে এসে তাঁরা মুগ্ধ। বলছিলেন, ‘‘এত সুন্দর পরিবেশ আর আতিথেয়তা! আবার আসব।’’
স্থানীয়দের উপার্জনের নানা রাস্তাও করে দিয়েছে রণ উৎসব। কিশোরী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে উৎসব চত্বর ঝাড়পোঁছ করতে আসা স্থানীয় গৃহবধূ বালু, সুরাত থেকে রান্নার কাজে আসা চন্দ্রকান্ত মগন বা আমদাবাদ থেকে আসা কলের মিস্ত্রি রামু— সকলের কাছেই এই তিনটে মাস রোজগারের ভাল সময়।
রণ নিয়ে তাই আরও পরিকল্পনা করছে গুজরাত সরকার। পর্যটনমন্ত্রী জানালেন, সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনসমৃদ্ধ ঢোলাবীরা থেকে কচ্ছ পর্যন্ত রাস্তা হবে। সে ক্ষেত্রে প্যাকেজ ট্যুরের আওতায় চলে আসবে ঢোলাবীরাও। গোটা রণকে সৌর বিদ্যুতের আওতায় আনারও চেষ্টা চলছে। আর চেষ্টা চলছে, বড় হোটেল ব্যবসায়ীদের এখানে টেনে আনার।
ধু ধু বালির প্রান্তরকে স্রেফ বিপণন-কৌশলে বিশ্বের দরবারে কী ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে তা দেখে স্তম্ভিত বাঙালি পর্যটকরা। সঙ্গে আক্ষেপ। বেহালা থেকে সপরিবার আসা কাঞ্চন বণিক, কাঁচরাপাড়ার নির্মলা বাগচী বলছিলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে তো কম দ্রষ্টব্য স্থান নেই। কিন্তু এরা যে ভাবে পর্যটনের উন্নয়ন ঘটিয়েছে, তার ছিটেফোঁটাও ওখানে হয়নি।’’
গুজরাত পারলে আমরা পারি না কেন? পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দফতরের এক কর্তার মতে, “সেই বাম আমল থেকেই এই দফতরের দুয়োরানি দশা। তা ঘুচতে সময় তো লাগবেই।” তবে এ রাজ্য পর্যটনে পিছিয়ে বলে মানতে নারাজ পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক কাজ হচ্ছে। গজলডোবায় পর্যটন হাব হচ্ছে। বিষ্ণুপুরেও থাকার ভাল জায়গা আছে।’’ তবে বেসরকারি লগ্নিকারীরা এগিয়ে এলে পরিকাঠামো গড়া আরও সহজ হবে বলে মানছেন মন্ত্রী।
তবে কি যথেষ্ট লগ্নি আসছে না পর্যটনে? রাজ্যে বিরোধী শিবিরের এক নেতার কথায়, “শিল্পের আদর্শ পরিবেশের অভাব, জমি নীতি, সিন্ডিকেট, সিঙ্গুর— সব মিলিয়েই তো সমস্যা।” আরও মনে করালেন, সিঙ্গুর থেকে তো ‘কচ্ছের রাজ্যে’ই চলে গিয়েছিল ন্যানো কারখানা!
প্রাক্তন এক আমলার মতে, তফাতটা গড়ে দিচ্ছে পেশাদারিত্ব। সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবসায়িক বুদ্ধি। তাই রণ উৎসবের উদ্বোধন করে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন পটেল গর্বভরে বলতে পারেন, ‘‘সরকারের পর্যটন পরিকল্পনার জন্যই এই উৎসব বিশ্বে সমাদৃত।’’
উৎসব চত্বর জুড়েও সেই গর্বের ঘোষণা— ‘কচ্ছ নেহি দেখা, তো কুছ নেহি দেখা!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy