Advertisement
E-Paper

‘পরিবর্তনে’ তেমন আগ্রহ নেই বাঙালির

কব্জি ডুবিয়ে সর্ষে-কাতলা খেতে খেতে এই নিখাদ আড্ডাটি চলছে যেখানে, সেই আমদাবাদের বস্ত্রপুরে সুপার প্লাজার নীচে মাছভাতে ম ম করছে রেস্তরাঁ।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২২ ০৭:৫৯
আমদাবাদের এক রেস্তরাঁর দেওয়ালে ভিক্টোরিয়ার ছবি। তার সামনে বসে মাছে মগ্ন বাঙালি। নিজস্ব চিত্র

আমদাবাদের এক রেস্তরাঁর দেওয়ালে ভিক্টোরিয়ার ছবি। তার সামনে বসে মাছে মগ্ন বাঙালি। নিজস্ব চিত্র

“ভোটের মাসখানেক আগে কৃষ্ণনগর লোকালে চাপুন। প্রতি পাঁচ মিনিটে তিন জন বিধায়ক, দু’জন নেতার নাম শুনবেন। সঙ্গে তুমুল তর্ক। এখানকার যেটা এসপ্ল্যানেড, সেই মানিকচকে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকুন। ভোট যে হচ্ছে সেটাই বুঝবেন না।”

কব্জি ডুবিয়ে সর্ষে-কাতলা খেতে খেতে এই নিখাদ আড্ডাটি চলছে যেখানে, সেই আমদাবাদের বস্ত্রপুরে সুপার প্লাজার নীচে মাছভাতে ম ম করছে রেস্তরাঁ। সুবিস্তীর্ণ আলু-পনির-ধোকলার জনপদে তুলি’জ রেস্তরাঁয় বাঙালিদের এক টুকরো ওয়েসিস যেন। কফি বা চা নয়, বিয়র তো নিষিদ্ধ, এখানে প্রতি সপ্তাহান্তে পাবদা মাছের ঝাল, পাঁঠার ঝোল এবং কলকাতা ধাঁচের বিরিয়ানির সঙ্গে আবর্তিত হয় বাঙালিদের আড্ডা। যাঁদের অর্ধেক পক্ককেশ, এখানে গোটা কর্মজীবন কাটিয়ে অবসরপ্রাপ্ত। অনেকেই অল্পবয়সি— আইআইএম আমদাবাদের ছাত্র-ছাত্রী অথবা সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া পেশাদার। সপ্তাহের মাঝে, রেস্তরাঁ ফাঁকা থাকলে তাঁরা গিটার বাজিয়ে গান ধরেন, ষোল আনা থেকে যদি বারো আনা যায়, হিসাবটা কষে দেখো দাঁড়ায় কোথায়..!

এই মাত্র কৃষ্ণনগর লোকালের সঙ্গে আমদাবাদের মানিকচকের তুলনাটি যিনি করলেন, তাঁর নাম সুদীপ্ত বিশ্বাস, নিবাস নদিয়ায়। আইআইএম দ্বিতীয় বর্ষ, মাঝে মাঝেই আসেন বন্ধু, প্রথম বর্ষের শুভার্থী মিশ্রের সঙ্গে। সমাজ, অর্থনীতি, ব্যক্তি ও বাজারের চরিত্র বুঝতে পাঠ্যক্রমের অঙ্গ হিসাবে এঁরা চলে যান গ্রামে, ঘুরে বেড়ান শহরে প্রশ্নের তালিকা নিয়ে। সুদীপ্ত বলছেন, “দমনের কাছে কাজু চাষিদের গ্রাম কাপরারায় গিয়ে কী দুর্দশা দেখেছি, ভাবার বাইরে। জীবনধারণের জন্য প্রায় কোনও পরিকাঠামোই নেই। জলের বিরাট সমস্যা। কোনও মতে খুবই সামান্য বাজরার চাষ করে রুটি খেয়ে থাকেন মানুষ। বহু দূরে মাসে এক বার হাট বসে, তখন যা কিছু কেনাকাটা।” তিনি আশ্চর্য, এত কষ্ট সত্ত্বেও মানুষ এখানে শান্তিপ্রিয়। বাংলার 'ঝাঁজ' নেই। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ রয়েছে, কিন্তু চোরা। ‘‘আমাদের রাজ্যে আবার উল্টো! সারাক্ষণ ঝগড়া, মারামারি চলছে, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সদ্ভাব অনেক বেশি এখানকার তুলনায়।’’

সে না হয় প্রত্যন্ত জনপদ। কিন্তু খোদ শহরে? আড্ডা জমে অন্য টেবলে। প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্তা, এককালে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা অশোক রাহা মন দিয়ে শুক্তো আর মাংসের ঝাল খেতে খেতে বলছেন, “এ এক আশ্চর্য ধাঁধা মশাই। আই টি সংস্থাগুলি ক্রমশই বাড়ছে এখানে, খুবই অল্পবয়সিরা সেখানে দাপটে কাজ করছেন। এঁরা বুড়ো নন, বয়সের ধর্মেই চান পাব কালচার, নাইট হপিং, যার কিছুই আমদাবাদে নেই। অন্য বড় শহরের তুলনায়, জিরো। অথচ তবুও দেখুন এখানে যুবানির্ভর শিল্পেরই বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে। আমাদের রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশিই হচ্ছে।”

‘আমাদের’ রাজ্য! এই দোকানের মালিক ইন্দ্রনীল মৃধা যে রাজ্যের। আমতলা থেকে তাঁর বাবা চলে এসেছিলেন কর্মসূত্রে আমদাবাদ। সেই থেকে তাঁরা এখানকার বাসিন্দা। বাংলার পাট না গুটিয়েই। কোভিডের সময় যখন এই দোকানটি ধুঁকছে (শহরের গোটা পাঁচেক বাঙালি রেস্তরাঁর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো) বুক ঠুকে ইন্দ্রনীল কিনে নেন পুরনো মালিকের থেকে। এখানকার সব কর্মচারী, কারিগরই হয় বাংলার নয়তো লাগোয়া ওড়িশার। লকডাউনের সময় তারা ফিরে গিয়েছিলেন মেদিনীপুর, হুগলি, হাওড়ায়। “কিন্তু টিকতে পারিনি দেশের বাড়িতে। রোজগার কোথায়? যান চলাচল শুরু হলেই ফিরে এসেছি আমদাবাদে। আমি একা নই, আমরা অনেকেই। এখানে মাইনে বিরাট কিছু না হলেও, চালিয়ে নিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছি”, বলছেন এই দোকানের সবচেয়ে পুরনো এক কর্মী নন্তে দাস।

ইন্দ্রনীল এই দোকানের পাশাপাশি বাঙালি মিষ্টির দোকান খুলেছেন, এরপর খুলবেন কাফে, যেখানে তেলেভাজা সিঙাড়ার সঙ্গে মিলবে দার্জিলিং চা। আমদাবাদে বঙ্গ খানার ঠেক হাতে গোনা তিন চারটি। কিন্তু তার বাইরে গুজরাতি, পঞ্জাবি বা অন্য অবাঙালি হোটেলে, কি রান্নায়, কি ম্যানেজারিতে, বাংলার গ্রাম, মফস্‌সল, শহরের সংখ্যাধিক্য স্পষ্ট। ইন্দ্রনীলের কথায়, “সাতাশ বছর ধরে বিজেপি যে এখানে রয়েছে তার কারণ তো রয়েছে। ঝুটঝামেলা কম। ব্যবসা করা অনেক সহজ। কথায় কথায় লোককে টাকা খাওয়ানো নেই। তবে এটাও বলব, গত এক বছরে দাম এখানে যা বেড়েছে দৈনিক পণ্যের, তা আমাদের বাংলার চেয়েও বেশি। বাজার বড়, অনেক লোকের হাতে টাকা, তাই এখানে সবাইকে বেতন, দু’বেলার খাওয়া দিয়েও চালিয়ে নিচ্ছি।” রসনায় তৃপ্ত, শান্তিপ্রিয় বঙ্গসমাজ, বাংলার গ্রাম থেকে আসা দু’বেলা দুটো রুটির জন্য লড়াই করা বাঙালিরা খুব একটা ‘পরিবর্তন’ এখানে চাইছেন বলে তো মনে হল না।

Gujarat BJP Bengali
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy