Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Bihar Assembly Election

ভোটে বিহার: মোদীর নাম নিতেও নারাজ পরিযায়ীরা

ভোটাররা যতটা ক্ষিপ্ত নীতীশে, ততটাই নরেন্দ্র মোদীর উপরে।

ভোট চিত্র: পটনার পালিগঞ্জে ভোটের লাইন। এমন দূরত্ব-বিধি অবশ্য মানা হয়নি রাজ্যের সর্বত্র। বিহারের মোট ২৪৩টি আসনের মধ্যে বুধবার প্রথম দফায় ৭১টি আসনের নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৫৪.২৬%। পিটিআই

ভোট চিত্র: পটনার পালিগঞ্জে ভোটের লাইন। এমন দূরত্ব-বিধি অবশ্য মানা হয়নি রাজ্যের সর্বত্র। বিহারের মোট ২৪৩টি আসনের মধ্যে বুধবার প্রথম দফায় ৭১টি আসনের নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৫৪.২৬%। পিটিআই

অনমিত্র সেনগুপ্ত 
বৈশালী শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২০ ০৩:৫৭
Share: Save:

“দয়া করে ওই নামটা মুখে নেবেন না।’’ শুনেই থমকে গেলাম। এত রাগ!

পটনা থেকে মুজফফরপুর যাওয়ার জাতীয় সড়ক আড়াআড়ি ভাবে চিরে দিয়েছে বৈশালী জেলাকে। পিচ-ঢালা মসৃণ রাস্তার দু’ধারে আদিগন্ত সবুজ জলাভূমি। খেতের জমিতে জমে থাকা কোমর-সমান বন্যার জল ফসলের মতোই পচন ধরিয়েছে শাসক এনডিএ-র জনভিত্তিতে।

কুদনি বিধানসভা কেন্দ্র। বিজেপির হয়ে দাঁড়িয়েছেন কেদারপ্রসাদ গুপ্ত। আরজেডি-র প্রার্থী পিছিয়ে থাকা শ্রেণির অনিল সাহানি। বৃজি রাজবংশের হাত ধরে সর্বপ্রাচীন গণতন্ত্র স্থাপন হয়েছিল যে বৈশালীতে, সেখানকার ভোটাররা যতটা ক্ষিপ্ত নীতীশে, ততটাই নরেন্দ্র মোদীর উপরে। রাস্তার পাশেই বন্ধ স্কুলের মাঠে জনা দশ-বারোর ভিড় দেখে কথা বলতে এগিয়ে গিয়েছিলাম। এলাকার বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ কাজের খোঁজে ফি-বছর দিল্লি-মুম্বই-হরিয়ানা যান। ফিরে আসেন ছটের সময়ে। কিন্তু এ বার করোনাভাইরাসের আক্রমণ আর লকডাউন তছনছ করে দিয়েছে বিকাশ-জীতেনদের জীবন।

কথায় কথায় উঠে এসেছিল মোদীর নাম। শুনেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন বছর পঁচিশের জীতেন। হরিয়ানায় মজুরের কাজ করতেন। জীতেনের কথায়, “নরেন্দ্র মোদীর জন্যই তো আজ আমাদের এই অবস্থা। এক ঘোষণায় সব বন্ধ করে দিলেন। কারও কথা ভাবলেন না। কাজ ছেড়ে এক কাপড়ে ফিরে আসতে হল। আসার সময়ে হাঙ্গামা-হুজ্জুতি যা হয়েছে, তা তো আলাদা। মজদুরি ছেড়ে চার-পাঁচ মাস গ্রামে পড়ে রয়েছি। ফিরে যাওয়ার টাকাটাও নেই। একদম ওই নাম মুখে আনবেন না। শুনলেই গা-পিত্তি জ্বলে যায়।’’

আরও পড়ুন: ক্ষমতার ‘অপব্যবহার’, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সাসপেন্ড করলেন রাষ্ট্রপতি

পরিযায়ীদের একাংশ, যাঁরা মূলত দিল্লি থেকে ফিরেছেন, তাঁরা কেজরীবাল সরকারের বদান্যতায় শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন পেলেও, অধিকাংশেরই গ্রামে আসার কাহিনি হল দুর্দশার খণ্ডচিত্র। যা ছড়িয়ে রয়েছে গোটা বিহার জুড়েই। যেমন, দানাপুরের দশরথ চকের বাসিন্দা মনোজ কুমার। পঞ্জাবে খেত-মজুরের কাজ করতেন। লকডাউনে বাড়ি ফেরার জন্য বিহারের প্রায় ষাট জন শ্রমিকের একটি দলের সঙ্গে মিলে ট্রাক ভাড়া করেছিলেন। ভাড়া এক লক্ষ টাকা। সেই ট্রাক মনোজদের বারাণসীতে নামিয়ে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে দেড় দিন হেঁটে এসে পৌঁছন বিহার সীমানায়।

সেখানেও হেনস্থার শেষ হয়নি। কারণ, লকডাউনের প্রথম পর্বে পরিযায়ীদের রাজ্যে ঢুকতে দেবেন না বলে প্রকাশ্যে সরব হয়েছিলেন নীতীশ। তাতে ভীষণ চটে পরিযায়ীরা। তাঁদেরই এক জন বিরজুর কথায়, “ভেবেছিলাম রাজ্যে ঢুকতে পারলে নিশ্চিন্ত। কিন্তু সরকার প্রথমে ঢুকতেই দেয়নি। খাবার-জল ছাড়া খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে হয় আমাদের।’’ এখানেই না-থেমে বিরজুদের অভিযোগ, পরিযায়ীদের এক হাজার টাকা করে দেওয়ার পরিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু কোথায় কী! অধিকাংশ শ্রমিকের একটি টাকাও জোটেনি। অথচ, কোষাগার থেকে টাকা গলে গিয়েছে। কে পেয়েছেন, কারও জানা নেই। হকের টাকা মার যাওয়ায় নীতীশ প্রশাসনের উপরে আরও খেপেছেন পরিযায়ীরা।

আরও পড়ুন: উপাসনাস্থল আইনে মথুরা এবং কাশীর মসজিদের নিরাপত্তা চায় ওয়াকফ বোর্ড

দিল্লিতে বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতাদের দাবি, লকডাউনের সময়ে গরিব পরিবার-পিছু পাঁচ কেজি খাদ্যশস্য দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত মোদী সরকার নিয়েছিল, সেটাই ভোটের হাওয়া বদলে দেবে। কিন্তু বাস্তব বলছে অন্য কথা। রেশনের কথা বলতেই দাঁত খেঁচালেন বৈশালীর বাসিন্দা বৃদ্ধ জয়প্রকাশ। “নেতারা কি জানেন, আমরা কতটা খারাপ চাল পেয়েছি? অধিকাংশ চাল শেষে গো-চারা হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। আর শুধু চাল-গম দিলে হবে! নগদ টাকার জোগান না-থাকলে বাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনব কী করে! প্রধানমন্ত্রীর বোঝা উচিত, থালা-বাটি বাজালে আর মোমবাতি জ্বালালে পেটের আগুন নেভে না।” পঞ্চম দফা আনলক পর্বে অর্থনীতিতে গতি আনতে প্রায় সব ক্ষেত্রই খুলে দিয়েছে মোদী সরকার। বৈশালীর গ্রামের বাসিন্দা শিবশঙ্কর কিংবা অর্জুন প্রসাদের মতো যাঁরা তামিলনাড়ুর কাপড়ের কারখানায় কাজ করতেন, তাঁদের ফেরাতে দু’টি বাস পাঠিয়েছিলেন কারখানা মালিক। কিন্তু বিকাশদের কপাল খুলেছে কই! দিল্লির ওখলা শিল্পতালুকে কাজ করত বিকাশ-সহ ১০-১২ জনের দলটি। অন্যদের কারখানা খুললেও, তাঁদের এখনও বন্ধ। মালিক জানিয়েছেন, চাহিদা নেই। নাগাল্যান্ডে কাঠের কাজ করতে যেতেন বৈশালীর বাল্মিকী রাম। আগে ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরায় বসে চলে যেতেন। এখন অধিকাংশই বাতানুকূল স্পেশাল ট্রেন। ভাড়া কয়েক হাজার টাকা। আগামী মাসেই বিহারবাসীর প্রধান উৎসব ছট পুজো। লকডাউনের কারণে ছ’মাস ধরে বসে থাকা শ্রমিকদের হাত কার্যত শূন্য। ছট পুজোয় নতুন কাপড় কোথা থেকে আসবে তারই কোনও হদিশ নেই, সেখানে কয়েক হাজার টাকা খরচ করে ট্রেনের টিকিট কাটবেন কী করে! নাগাল্যান্ড তো অনেক দূর। পরিযায়ী শ্রমিকেরা এতটাই কর্পদকশূন্য যে বাসের টিকিট কেটে পটনা যাওয়ার সামর্থ্য নেই অধিকাংশের। মোকামার ভগবানপ্রসাদ বললেন, “আগে ট্রেন ধরে পটনা চলে যেতাম। মজদুরির কাজ জুটে যেত। এখন বাসে করে যেতে হলে কয়েকশো টাকার ধাক্কা। কোথা থেকে পাব! যা ছিল তা দিয়ে লকডাউনের কয়েক মাস চালিয়েছি। জানি না এর পরে কী হবে।”

পরিযায়ীদের জন্য বিকল্প আর্থিক সংস্থান না করতে পারা নিয়ে যে ক্ষোভ ছিল, তা উস্কে দিয়েছেন এলজেপি নেতা চিরাগ পাসোয়ান-সহ অন্য বিরোধীরা। পরিযায়ীদের শ্রমিকদের বড় অংশ তাই এই মুহূর্তে শাসক শিবিরকে পাল্টা শিক্ষা দিতে কোমর কষছেন। প্রচারে নেমে সেই ক্ষোভের আঁচ পেয়েছেন এনডিএ নেতারাও। যা দেখে বিলক্ষণ ঘাবড়েছে শাসক শিবির। জেডিইউয়ের পটনার সদর দফতরে শুকনো মুখে বসে থাকা দলের মুখপাত্র অজয় অলোক স্বীকার করে নিচ্ছেন, “এত ক্ষোভ জমে রয়েছে, বোঝা যায়নি।’’ পরিস্থিতি সামলাতে আদর্শ আচরণবিধি ভুলে শিক্ষিত, বেকার ও পরিযায়ীদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিজেপি নেতা তথা উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদী। যা শুনে আরজেডি-র তেজস্বী যাদবের সুরে পরিযায়ীরা পাল্টা প্রশ্ন করছেন, পনেরো বছরে নীতীশ-সুশীল মোদী জুটি কেন তা করতে ব্যর্থ হল! যার জুতসই জবাব খুঁজে চলেছেন এনডিএ নেতৃত্ব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE