বাদল অধিবেশন শেষ হওয়ার এক দিন আগে হঠাৎই উত্তেজনা ছড়াল সংসদে। ‘সৌজন্যে’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পেশ করা ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল। যাতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য কোনও মন্ত্রী যদি টানা ৩০ দিন হেফাজতে থাকেন, তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গেই শাহ বুধবার পেশ করেছেন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকার (সংশোধনী) বিল, জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন (সংশোধনী) বিল। তিনটি বিলেরই বিরোধিতা করা হয়েছে বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র তরফে। লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী এবং তৃণমূলের লোকসভার নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ এই বিল আইনে পরিণত হলে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে রাজনৈতিক কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে শাসক বিজেপি। বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলিতে মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীদের এই আইনের মাধ্যমে বিপদে ফেলা হতে পারে।
শাহের বিতর্কিত বিল অবশ্য বুধবার লোকসভায় পাশ হয়নি। বিরোধী সাংসদদের প্রবল প্রতিবাদ এবং হট্টগোলের আবহে বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। তবে বুধে ধ্বনিভোটে বিরোধীদের একাংশের বিতর্কের দাবি উড়িয়ে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল লোকসভায় ধ্বনিভোটে পাশ করিয়ে নিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। ওই বিল অনুযায়ী ভারতে এ বার নিষিদ্ধ হতে চলেছে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত সমস্ত ধরনের অনলাইন গেমিং। ‘দ্য প্রমোশন অ্যান্ড রেগুলেশন অব অনলাইন গেমিং বিল, ২০২৫’ নামের ওই বিলে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত অনলাইন গেমিং পরিচালনা করলে এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং তিন বছর পর্যন্ত জেলের সাজার প্রস্তাব রয়েছে। প্রচারের উপরেও জরিমানা বসানোর প্রস্তাব রয়েছে। লোকসভায় এই বিল পাশের ফলে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ফ্যান্টাসি স্পোর্টস গেমিং সংস্থাগুলিরও ভবিষ্যৎ।
কী রয়েছে বিতর্কিত বিলে?
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পেশ করা ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিলে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী-সহ কেন্দ্র বা রাজ্যের যে কোনও মন্ত্রী যদি গুরুতর অপরাধের অভিযোগে টানা ৩০ দিনের জন্য হেফাজতে থাকেন, তবে ৩১তম দিন থেকে তিনি মন্ত্রিত্ব হারাবেন। পাঁচ বছর বা তার বেশি জেল হতে পারে, এমন অপরাধগুলিকে ‘গুরুতর’ হিসাবে ধরা হবে।
বিলের কাগজ ধেয়ে এল শাহের দিকে
বুধবার লোকসভায় মোট তিনটি বিল পেশ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র শাহ। ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকার (সংশোধনী) বিল, জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন (সংশোধনী) বিল পেশ করেন তিনি। তিনটি বিল পেশ হতেই বিরোধীরা তুমুল হট্টগোল শুরু করেন লোকসভায়। ওয়েলে নেমে স্লোগান তুলে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তাঁরা। বিলের প্রতিলিপি (কপি) ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানান বিরোধী সাংসদেরা। তাঁর দিকে বিলের প্রতিলিপি দলা পাকিয়ে ছোড়াও হয়। বস্তুত, বিরোধীদের বিক্ষোভের কারণেই শাহ বুধবার বাধ্য হন নিজের আসন ছে়ড়ে চতুর্থ সারিতে গিয়ে বসতে এবং সেখান থেকে নিরাপত্তা পরিবেষ্টিত হয়ে বিল পেশ করতে। অন্তত ২০ জন মার্শাল বিল পেশের সময় শাহকে ঘিরে ছিলেন বলে দাবি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
কী অভিযোগ বিরোধীদের?
কংগ্রেসের মনীশ তিওয়ারি, কেসি বেণুগোপাল, মিম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি-সহ অন্য সাংসদেরা ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল পেশের পরেই বিরোধিতায় সরব হন লোকসভায়। তাঁদের অভিযোগ, এই বিল সংবিধান এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। যদিও বিরোধীদের অভিযোগ অস্বীকার করেন শাহ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এই বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হবে (শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে)। সেখানে সংসদের উভয় কক্ষের শাসক-বিরোধী সাংসদেরা থাকবেন।
তবে এর পরেও বিরোধীদের হট্টগোল বন্ধ হয়নি। শেষে বিরোধীদের হট্টগোলের জেরে দুপুর ৩টে পর্যন্ত মুলতুবি হয়ে যায় লোকসভার অধিবেশন। পরে বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়ঙ্কা গান্ধী অভিযোগ করেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপের কথা বলে স্রেফ সাধারণ মানুষের চোখে পট্টি পরানো হচ্ছে। তাঁর কথায়, “ভবিষ্যতে যে কোনও মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে কোনও মামলা করা যেতে পারে। তিনি দোষী সাব্যস্ত না হলেও তাঁকে ৩০ দিন হেফাজতে রেখে দেওয়া হতে পারে। তার পরে তিনি আর মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। এটি সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী, অগণতান্ত্রিক এবং অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।”
কেন্দ্রের নিশানায় বিরোধীরা
১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল পেশের পরে লোকসভায় বিরোধীদের আচরণের নিন্দা করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার। পাশাপাশি, বিতর্ক এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বার্তা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু বলেন, ‘‘দেশের জনগণ আমাদের এখানে কাজ করতে পাঠিয়েছেন। বিরোধীরা কি শুধু হট্টগোল করতেই এখানে আসেন? গণতন্ত্রকে অপমান করলে মানুষ ক্ষমা করবে না। সাংসদদের জনগণের রায়কে অশ্রদ্ধা করা উচিত নয়। আলোচনা এবং বিতর্কের মাধ্যমে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত।’’
লোকসভায় পাশ অনলাইন গেমিং বিল
সংবিধান সংশোধনী বিল নিয়ে বিরোধী সাংসদদের বিক্ষোভের মধ্যেই বৈদ্যুতিন এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পরে বুধবার লোকসভায় ধ্বনিভোটে পাশ হয় অনলাইন গেমিং সংক্রান্ত বিলটি। বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ব্যাঙ্ক এবং অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত অনলাইন গেমের জন্য তহবিল স্থানান্তর বা সহায়তাতেও বিধিনিষেধ জারির প্রস্তাব রয়েছে নয়া বিলে। ‘দ্য প্রমোশন অ্যান্ড রেগুলেশন অব অনলাইন গেমিং বিল, ২০২৫’ নামের ওই বিলে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত অনলাইন গেমিং পরিচালনা করলে এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং তিন বছর পর্যন্ত জেলের সাজার প্রস্তাব রয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরেই ভারতে অনলাইন গেমিং শিল্পকে একটি উদীয়মান ক্ষেত্র হিসাবে দেখা হচ্ছে। অনলাইন গেমে বাজি ধরার পিছনে প্রতি মাসে ভারতে গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। তাই গত কয়েক বছরে গেমিং শিল্পে ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে বহু ছোট-বড় সংস্থা। ফলে এমন আইন কার্যকর হলে ক্ষতির মুখে পড়বে বহু সংস্থা। কাজ হারাতে পারেন দুই লক্ষ মানুষ। পাশাপাশি কয়েক হাজার কোটি টাকার জিএসটি হারাবে সরকার।
রাজ্যসভায় পাশের পরে এই বিল আইনে পরিণত হলে প্রশ্নের মুখে পড়বে ফ্যান্টাসি স্পোর্টস গেমিং সংস্থাগুলিরও ভবিষ্যৎ। যদিও এর মধ্যে বেশিরভাগ সংস্থারই দাবি, তারা বাজি ধরা, টাকা নয়ছয় করা কিংবা অবৈধ জুয়া খেলার মতো কোনও রকম ‘অবৈধ কার্যকলাপে’ জড়িত নয়। ফ্যান্টাসি গেমিংয়েও টাকার লেনদেন হয় বটে, তবে ঘুরপথে। এই ধরনের খেলায় প্রথমে অল্প টাকার বিনিময়ে পরিচিত তারকা বা খেলোয়াড়দের নিয়ে তালিকা বানাতে হয়। সেই খেলোয়াড়েরা বাস্তবে কেমন ফল করলেন, তার ভিত্তিতে টাকা লেনদেন হয়। জিতলে লক্ষ লক্ষ টাকার পুরস্কারের হাতছানি থাকে। একে সরাসরি ‘জুয়া’ বলা যায় না।
রাজ্যসভায় ওয়াকআউট বিরোধীদের
লোকসভার পাশাপাশি বুধবার বিরোধীদের বিক্ষোভের জেরে অশান্তি হয় রাজ্যসভাতেও। উপলক্ষ, বিধানসভা ভোটের আগে বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ সার্বিক পরিমার্জন (এসআইআর)। দফায় দফায় বিক্ষোভ প্রদর্শনের পরে বিরোধীরা সংসদের উচ্চকক্ষ থেকে ওয়াকআউট করে অধিবেশন থেকে।