Advertisement
E-Paper

বিজেপি নেতাদের ধরে বেকায়দায় এসপি

শিলচরের বিজেপি বিধায়ক দিলীপ পালকে কি গ্রেফতার করা হয়েছিল? নাকি আটক করা হয়েছিল? গ্রেফতার করা হলে কোন ধারায়? আটক করলে তাঁর মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হল কেন?

উত্তম সাহা

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৮
শিলচর আদালত চত্বরে পুলিশের সঙ্গে বিতন্ডা বিজেপি বিধায়ক দিলীপ পালের। শনিবার। ছবি: স্বপন রায়।

শিলচর আদালত চত্বরে পুলিশের সঙ্গে বিতন্ডা বিজেপি বিধায়ক দিলীপ পালের। শনিবার। ছবি: স্বপন রায়।

শিলচরের বিজেপি বিধায়ক দিলীপ পালকে কি গ্রেফতার করা হয়েছিল? নাকি আটক করা হয়েছিল? গ্রেফতার করা হলে কোন ধারায়? আটক করলে তাঁর মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হল কেন? থানার সামনে বিক্ষোভ দেখাতে গেলে বিজেপি কর্মীদের উপর লাঠিচার্জ করা হল কেন? কোনও প্রশ্নেরই জবাব নেই পুলিশের কাছে। জেলা প্রশাসনের বক্তব্য, ‘‘এসপি আমাদের কিছুই জানাননি। তাঁর অভিজ্ঞতার অভাব। পুরো ঘটনার ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’

ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তের নির্দেশে সন্তুষ্ট নয় বিজেপি। সমগ্র ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে সোমবার ১২ ঘণ্টার কাছাড় জেলা বন্‌ধের ডাক দিয়েছে তারা। পুলিশ সুপার রজবীর সিংহের বদলি, পঞ্চায়েত সভাপতিদের উপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করারও দাবি জানিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব। পুলিশ সুপারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি অবশ্য এরই মধ্যে মিটে গিয়েছে। রজবীর সিংহ বিধায়ক দিলীপকুমার পাল এবং বিজেপির জেলা সভাপতি কৌশিক রাইয়ের কাছে পুরো ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি নাকি তাঁদের জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মুখ্যমন্ত্রীর চাপ ছিল। তাই তিনি কড়া পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। পুলিশ সুপারের দুঃখ প্রকাশের পরও বিজেপি নেতাদের রাগ কমেনি। তাঁরা ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসকের ডাকা সর্বদলীয় সভাও বয়কট করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে।

ঘটনার সূত্রপাত গত ১২ সেপ্টেম্বর সকালে। মেহেরপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে রাস্তা অবরোধ হয়। সে সময় বিজেপি নেতা তথা পঞ্চায়েত সভাপতি দেবাশিস দাস শারীরিক নিগ্রহের শিকার হন। কাল একই এলাকায় গোষ্ঠী সংঘর্ষে আহত হন আরেক পঞ্চায়েত সভাপতি বিদ্যুত্ দে। খবর পেয়ে ছুটে যান পুলিশ সুপার রজবীর সিংহ ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুভাষিণী শঙ্করণ। লাঠিচার্জ করে উভয় গোষ্ঠীর লোকদের সেখান থেকে সরিয়ে দেন। ন’জনকে থানায় এনে আটকে রাখা হয়। তার জেরে আজ সকালে ফের উত্তেজনা ছড়ায়।

বিজেপির জেলা নেতারা দলীয় কর্মকর্তা উদয়শঙ্কর গোস্বামীর বাড়িতে বৈঠক করেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ, শিলচরের বিধায়ক দিলীপ পাল, দলের জেলা সভাপতি কৌশিক রাই, যুব মোর্চার জেলা সভাপতি রাজেশ দাস-সহ অনেকেই সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সভা সেরে বেরিয়ে এলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুভাষিণী শঙ্করণ তাঁদের পাঁচ জনকে তারাপুর পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যান। সেখানে বসেছিলেন পুলিশ সুপার রজবীর সিংহ। তিনি তাঁদের গ্রেফতারের কথা জানান। দিলীপকুমার পাল, কৌশিক রাই, রাজেশ দাস ছাড়াও গ্রেফতার করা হয় বিজেপির শিলচর (গ্রামীণ) কমিটির সভাপতি বাবু সিংহ এবং শহর কমিটির প্রাক্তন সভাপতি গোপাল রায়কেও।

খবর পেয়ে দলের কর্মী-সমর্থকরা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখান। জাতীয় সড়কে অবরোধ গড়ে তোলেন। ধৃত নেতাদের খবর নিতে গিয়েছিলেন শিলচর শহর কমিটির সভাপতি দীপায়ন চক্রবর্তী। গ্রেফতার করা হয় তাঁকেও। উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। পুলিশ লাঠি চালিয়ে সবাইকে হঠিয়ে দেয়। ২০ জনের বেশি বিজেপি কর্মী লাঠির ঘায়ে জখম হন। তাঁদের অধিকাংশই আবার মহিলা। শিলচর পুরসভার সদস্য মিত্রা রায় এবং রাখি চৌধুরীও জখম হয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজন পথচারীও রয়েছেন।

লাঠিচার্জের পরই পুলিশ সুপার নিজে ফাঁড়ি থেকে দিলীপবাবুদের নিয়ে রওনা হন। তাঁদের আদালত চত্বরে নিয়ে যাওয়া হয়। চতুর্থ শনিবার বলে আজ ছিল ছুটির দিন। খবর পাঠানো হয় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে। আদালত চত্বরে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। বিজেপি নেতারা সিদ্ধান্ত নেন, আদালতে তোলা হলে তাঁরা জামিনের আবেদন জানাবেন না। এর মধ্যেই দলের রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজদীপ রায় সোমবার ১২ ঘণ্টার বন্‌ধের কথা ঘোষণা করেন।

এর পরই পুলিশ সুপার দিলীপবাবুদের কাছে গিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেন। ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসক এম কে দাস ধৃত পাঁচজনকেই মুক্তি দেওয়ার কথা জানান। বিজেপি রিলিজ অর্ডার দাবি করে। কিছুক্ষণ পর রিলিজ অর্ডার নিয়ে যান রাঙ্গিরখাড়ি ফাঁড়ির ইনচার্জ মলয় আচার্য। সেটি ম্যাজিস্ট্রেটের সই করা। ১০৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয় তাঁদের বিরুদ্ধে। ক্ষেপে ওঠেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। প্রশ্ন তোলেন, একজন বিধায়ককে অধ্যক্ষের অনুমতি ছাড়া ১০৭ ধারায় গ্রেফতার করা যায় কিনা? এ ছাড়া, আদালত চত্বরে যখন আনা হল, সিজেএমকে ডেকে আনা হল, তখন ম্যাজিস্ট্রেট কেন মুক্তির নির্দেশ দেবেন? মলয়বাবু কোনও জবাব দিতে পারেননি। প্রকাশ্যেই নিজের অসহায়তার কথা জানিয়ে দেন। অসহায় দেখায় তারাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নিরূপম নাথকেও। শেষ পর্যন্ত তাঁরা বিজেপি নেতাদের ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসকের কাছে নিয়ে যান।

ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসক এম কে দাসের বক্তব্যে পুলিশকর্তাদের সঙ্গে দূরত্বের ব্যাপারটি স্পষ্ট ধরা পড়ে। তিনি বলেন, ‘‘কাল রাতে ও আজ দুপুরে লাঠি চালানো হল। পুলিশ আমাকে কিছুই জানায়নি। বিধায়ক গ্রেফতারের কিছু নিয়মনীতি রয়েছে। সেগুলিও মানা হয়নি। ভারতীয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ ধারায় গ্রেফতারের কথা বলছিলেন এসপি। আমিই বলেছি, এতে সমস্যা হবে। মামলা যাবে বিচারকদের কাছে। জটিলতা বাড়বে। পরে ১০৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়, যাতে এগজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটই তাঁদের রিলিজ করে দিতে পারেন।’’

তিনি সব ভুলে বিজেপি নেতাদের সর্বদলীয় সভায় যোগ দিতে অনুরোধ করেন। তাঁরা সেই অনুরোধ প্রত্যাখান করেন। গোষ্ঠী সংঘর্ষ বন্ধের ব্যাপারে ডাকা সর্বদলীয় সভায়
উপস্থিত হন পরিবহণ মন্ত্রী অজিত সিংহ ও কারা মন্ত্রী গিরীন্দ্র মল্লিক। ছিলেন বিধায়ক আতাউর রহমান মাঝারভুইয়া-সহ কংগ্রেস, এআইইউডিএফ, সিপিএম, সিপিআই নেতৃবৃন্দ। সবাই শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। বাম নেতারা কঠোর হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পুলিশ সুপারকে ধন্যবাদ জানান। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিধায়ককেও অধ্যক্ষের অনুমতি ছাড়া গ্রেফতার করা যায় বলে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের উল্লেখ করেন সিপিআই নেতা রফিক আহমদ।

পুলিশ সুপার রজবীর সিংহ জানান, ‘‘বিধায়ককে গ্রেফতারের নিয়মনীতি আমার জানা ছিল না। তাই ধৃতদের আদালতে তোলার জন্য নেওয়া হয়েছিল। পরে জেলা প্রশাসনের পরামর্শে ১০৭ ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়।’’ তিনি জানান, আজ সকালে সভা সেরে বিজেপি নেতারা সড়ক অবরোধ করছিলেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অবরোধ তুলতে গেলে বিবাদ বাধে। উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে বিধায়ক-সহ পাঁচজনকে সেখান থেকে তুলে আনা হয়। এর মধ্যে কোনও পক্ষপাতিত্ব ছিল না। কোনও ব্যক্তিস্বার্থও লুকিয়ে নেই। তিনি যা করেছেন, সিআরপিসি-আইপিসি মেনেই করেছেন।

বিজেপির অভিযোগ, রজবীর সিংহ এর আগে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। বিজেপিকে শায়েস্তা করার জন্য দু’মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে কাছাড়ে পাঠিয়েছেন। সে কাজটাই তিনি করছেন। বিধায়ককে অশালীন কথাবার্তা বলেছেন।
দলের শহর কমিটির সভাপতি দীপায়ন চক্রবর্তীকে বেদম পিটিয়েছেন। তাঁর চশমা ভেঙে দিয়েছেন। দীপায়ন পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ করে অভিযোগ দায়ের করেছেন। রজবীর সিংহের
বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের কথা জানিয়েছে বিজেপির লিগ্যাল সেলও। লিগ্যাল সেলের নেতারা বলেন, আদালত তাঁদের কাজের জায়গা। আগাম নোটিশ ছাড়াই আজ পুলিশ সুপার আইনজীবীদের আদালতে ঢুকতে দেননি। বিচার বিভাগীয় বিষয় না হওয়া সত্ত্বেও অভিযুক্তদের আদালত চত্বরে ঢোকানোর ব্যাপারটিও তাঁরা সিজেএম-এর নজরে আনেন।

ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসক এম কে দাস জানিয়েছেন, তিনি পুরো ঘটনা লিখিতভাবে মুখ্যসচিবকে জানাবেন।

bjp Silchar congress police
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy