সকাল ৯টা। ঘণ্টাখানেক ভোট গণনা শুরু হয়েছে। প্রাথমিক প্রবণতাই ইঙ্গিত দিল, কপাল মন্দ শাসক দলের। তাবড় মন্ত্রী গৌতম রায়, রকিবুল হুসেন, নজরুল ইসলাম, পৃথ্বী মাঝি, বিস্মিতা গগৈ, অজিত সিংহ, এটোয়া মুণ্ডা, প্রদ্যোৎ বরদলৈরা পিছিয়ে পড়ছেন। বিজেপি যেখানে ৩১টি আসনে এগিয়ে কংগ্রেস এগিয়ে মাত্র ১৫টিতে। অগপ ১২টি আসনে এগিয়ে। বিপিএফও ৫টিতে। টিভিতে সেই ফল দেখেই সর্বানন্দ সোনোয়ালের নাম নিয়ে বাঁধা বিহু গানের সঙ্গে নাচতে শুরু করে দিলেন গুয়াহাটির বিজেপি সাংসদ বিজয়া চক্রবর্তী। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ তখন কামাখ্যায় প্রার্থনারত। সেখানে পুজো সেরেই তিনি গুয়াহাটির বুড়া মসজিদে ঢোকেন। পরের গন্তব্য আর জি বরুয়া রোডের নামঘরে। তারপর যান রুক্মিণীগাঁওয়ের একটি গির্জায়। হেঙেরাবাড়ির বিজেপি দফতরে ততক্ষণে রীতিমতো বিজয়োৎসবের আবহ। অন্য দিকে, সুনসান কংগ্রেসের সদর দফতর রাজীব ভবন।
সকাল ১০টা ৫০ মিনিট। প্রথম জয়ের খবর এল বিজেপি শিবিরে। থাওরায় বিজেপির প্রার্থী কুশল দুয়ারি ১৫ হাজার ভোটে বিজয়ী। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া বিজেপি দফতরে হাজির রাম মাধবের কথায়, “২০১৪ সালের হারের পরেও কংগ্রেস কোনও শিক্ষা নেয়নি। জনতা আর সুযোগ দিতে রাজি নয়। এখন জয়ের আনন্দ উপভোগ করতে দিন। কথা পরে হবে।”
সকাল সাড়ে ১১টা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অঞ্জন দত্তর কন্যা অঙ্কিতা দত্তকে হারিয়ে অগপ-র প্রদীপ হাজরিকার জয়ের খবর এল। মাঝবাটে বিপিএফ প্রার্থী চরণ বড়ো, পানেরিতে কমলি বসুমাতারি, উদালগুড়িতে রিহন দৈমারি ও হাজোয় বিজয়াদেবীর মেয়ে সুমন হরিপ্রিয়া জয়ী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ফোন এল সর্বানন্দ সোনোয়ালের মোবাইলে। আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার আগেই ৮১টি আসনে এগিয়ে থাকা বিজেপি নেতাকে জয়ের অভিনন্দন জানিয়ে দিলেন মোদী। আর অপেক্ষা নয়, হাজারো বিজেপি সমর্থক আবীরে, গানে, আতসবাজিতে মেতে উঠলেন। শুরু হল সমবেত বিহু নাচ।
বেলা ১২টা ১০ মিনিট। টুইটারে অসমে পরাজয় স্বীকার করে নিলেন এআইসিসি সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী।
বেলা ১টা ৩০ মিনিট। নিজেই ফোন করে ভাবী মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দকে অভিনন্দন জানালেন তরুণ গগৈ। গগৈয়ের কাছে আশীর্বাদ চাইলেন সর্বানন্দ।
শেষ হল রাজ্যে ১৫ বছরের টানা কংগ্রেস শাসন। ২০০১ সালে গুপ্তহত্যা, দুর্নীতি ও অপশাসনে জর্জরিত অগপর হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু এবারের জয় তার চেয়েও আশাতীত। গত বিধানসভায় মাত্র ৫টি আসন পাওয়া বিজেপি এবার একাই ৬৩টি আসন পেয়ে গিয়েছে। তাদের জোট শরিক অগপ ১২টি, বিপিএফ ১২টি। ১২৬ আসনের বিধানসভায় জোটের দখলে ৮৭টি আসন। কংগ্রেস মাত্র ২৫টি আসন। আর আজমলের দল পেয়েছে ১৩টি আসন। হেরেছেন আজমল নিজে।
গত ১৫ বছরে অসমকে অনেকটাই সুস্থির ও সমৃদ্ধ যে কংগ্রেস করেছে, তাতে কারও দ্বিমত নেই। অগপর বিরুদ্ধে মাইনে না দেওয়া, গুপ্তহত্যার মতো শোচনীয় অভিযোগ ছিল। তেমন বড় কোনও অভিযোগ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নেই। কিন্তু পরিবারতন্ত্র, দলের বিদ্রোহ, নেতাদের স্বার্থের লড়াই আর কয়েকজন মন্ত্রীর দুর্নীতি এবং হঠকারি মন্তব্যের যোগফলে অসমবাসীর মন থেকে ক্রমশ সরে গিয়েছে কংগ্রেস। দলের দ্বন্দ্ব মেটাতে ব্যস্ত কংগ্রেস নেতৃত্বও মানুষের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। তারই মিলিত রূপ আজকের ভোট-ফল।
এর আগে দু’দফায় বিধানসভা ও লোকসভায় হাত মিলিয়ে লড়লেও অগপ ও বিজেপির নেতৃত্ব বা তৃণমূল স্তরে লক্ষ্য ও আদর্শে মিল ছিল না। হাতে হাত রেখে, কোমর বেঁধে নামার এবারের ছবিও আগে দেখা যায়নি। কিন্তু সর্বানন্দ, হিমন্তবিশ্ব শর্মা, হাগ্রামা মহিলারি আর অতুল বরার নেতৃত্বে সেই ঘটনাই ঘটেছে এবার। সঙ্গে তীব্রভাবে কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাব এবং পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে অসমবাসীর ক্ষোভ। তাই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ঘাটোয়ার, বর্মণ, দেব, রায়দের হার হয়েছে। অনেক স্থানেই কংগ্রেসের হেভিওয়েট প্রার্থীদের হারিয়েছেন তুলনায় অখ্যাত প্রার্থীরা।
সর্বা ও হিমন্তের প্রচারের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষকে বোঝানো, ক্ষমতায় এলে কংগ্রেস আজমলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অসমকে ‘মিনি বাংলাদেশ’ করে ফেলবে। সেই লক্ষ্যে সফল তাঁরা। বরাকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসা হিন্দুদের ভারতে থাকার অধিকার দেওয়া হবে বলে সরকারি বিজ্ঞপ্তি দেয় বিজেপি। স্বপ্নের ব্রডগেজ চালু করে। কলকাতা ও দিল্লির সঙ্গে বরাকের সরাসরি রেল যোগাযোগও শুরু করে দেয়। পরিবর্তিত ও বিকাশিত অসমের ছবিও সফলভাবে অসমবাসীর মনে ঢোকান সুকৌশলী হিমন্ত। কংগ্রেসনেতারা এতদিন গোপনে মেনে নিতেন, হিমন্তকে হারানো কংগ্রেসের বড় ক্ষতি। আজ রাজীব ভবনে দাঁড়িয়ে অনেকে তা মুখ ফুটে বলেই ফেললেন।
জয়ের জন্য নরেন্দ্র মোদীর গত দু’বছরের নীতিকে তুলে ধরছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁদের মতে দিল্লি থেকে প্রতি মাসে নিয়ম করে ৩-৪ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে অসমে পাঠিয়েছেন মোদী। তাই মানুষ আগের মতো নিজেদের কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করছিল না। সেই সঙ্গে নির্বাচনের সময় মোদী অসমের নামনি থেকে উজানি অংশে যে ভাবে নাগাড়ে প্রচার চালিয়েছেন তার জন্য রাজ্য নেতৃত্ব কৃতজ্ঞ। হিমন্তর মতে, “প্রধানমন্ত্রীই যখন আমাদের জন্য এতটা অমানুষিক পরিশ্রম করছেন, তখন জিতে সেই ঋণ শোধ করার দায় তো আমাদের।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy