Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভেসেই কি যাবে সুখের সংসার

১ অগস্ট জামিন হয়েছে সুলতা (নাম পরিবর্তিত) সিংহের। মনোজ (নাম পরিবর্তিত) তাঁকে নিয়ে ফিরে গিয়েছেন ঝাড়খণ্ডের জামতাড়ায়, নিজের বাড়ি। আদালতে আবার শুনানি হবে। আসতে হবে কলকাতায়। তাঁরা একশো বার আসতে রাজি আছেন। কিন্তু বিচারের শেষে তো সুলতাকে ফিরে যেতে হবে তাঁর নিজের দেশ, বাংলাদেশে! আর কি কোনও দিন এ দেশে আসতে পারবেন সুলতা?

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৭ ০৭:৩০
Share: Save:

তাঁদের ভালোবাসার পথে অজস্র কাঁটা। যে কোনও দিন আলাদা হয়ে যেতে পারে জাপটে ধরা হাত দুটো। মাঝে এসে নির্দয় ভাবে দাঁড়াতে পারে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া, আইন-আদালত। তবু দু’জনের চোখে শুধুই আকুতি, কোনও উপায় কি নেই!

১ অগস্ট জামিন হয়েছে সুলতা (নাম পরিবর্তিত) সিংহের। মনোজ (নাম পরিবর্তিত) তাঁকে নিয়ে ফিরে গিয়েছেন ঝাড়খণ্ডের জামতাড়ায়, নিজের বাড়ি। আদালতে আবার শুনানি হবে। আসতে হবে কলকাতায়। তাঁরা একশো বার আসতে রাজি আছেন। কিন্তু বিচারের শেষে তো সুলতাকে ফিরে যেতে হবে তাঁর নিজের দেশ, বাংলাদেশে! আর কি কোনও দিন এ দেশে আসতে পারবেন সুলতা? ‘অনুপ্রবেশকারী’ সুলতাকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে মনোজের বিরুদ্ধেও মামলা চলছে। তিনিও ১০ দিন জেল খেটেছেন। ফলে সুলতা বাংলাদেশে চলে যাওয়ার পরে মনোজের ভিসা পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। যে আইনজীবী তাঁদের মামলা লড়ছেন, সেই নবীন শাহ-র কথায়, ‘‘দেখি কী হয়। দু’জন যাতে একসঙ্গে থাকতে পারেন, তার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করব।’’

ঢাকায় কাপড়ের কারখানায় কাজ করতেন সুলতা। স্বামীর নিত্যদিনের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ২০১৪ সালে বেআইনি ভাবে সীমান্ত টপকে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে। ও পারে রয়ে যান মা ও ছ’বছরের মেয়ে। যে সঙ্গিনীর হাত ধরে দেশ ছাড়েন, তাঁর আশ্বাস ছিল কলকাতায় প্রসাধনী দোকানে ২০ হাজার টাকার চাকরি হবে। সঙ্গে ছিল বান্ধবী মায়া। কিন্তু দুই যুবতীকে সোনাগাছিতে বিক্রি করে পালিয়ে যায় সেই সঙ্গিনী। দুই বন্ধু তিন দিন না খেয়ে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেন। শেষে হুমকি আসে, ‘হয় এক লক্ষ টাকা করে দাও, নয় তো পুলিশের হাতে তুলে দেব।’ বেআইনি ভাবে দেশ ছেড়ে আসা অসহায় দুই যুবতীর তখন দেহ-ব্যবসা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।

মনোজ ছিলেন জামতাড়ায়। ২০১৩ সালে স্ত্রী মারা যান ছ’মাসের ছেলে আয়ুষকে রেখে। পরিবহণের ব্যবসায় মজে ছিলেন মনোজ। আসতে হতো কলকাতায়। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সোনাগাছি যান। সেখানেই আলাপ হয় সুলতার সঙ্গে। সুলতা তখনও পালানোর পথ খুঁজছিলেন। মনোজের সঙ্গে আলাপ জমে ওঠার পরে সুলতা ও মায়া সাহায্য চান। বলেন, কোনও ভাবে তাঁরা আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে চান। সেই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি মনোজ সুকৌশলে দুই যুবতীকে নিয়ে পালিয়ে যান সোনাগাছি থেকে। ওঠেন সদর কলকাতার একটি হোটেলে। মায়ার পুরুষ বন্ধু এসে মায়াকে নিয়ে যান।

পরের দিন কলকাতা থেকে গাড়ি ভাড়া করে সুলতাকে নিয়ে বনগাঁ সীমান্তে পৌঁছন মনোজ। সেখানে এক গাড়িচালককে আগে থেকে চিনতেন। তিনিই সাহায্য করেন। কিন্তু সে দিন সুলতা সীমান্ত পেরোনোর সময়ে বুক কেঁপে ওঠে দু’জনেরই। এই আলাপচারিতা, বন্ধুত্ব, বিপদের দিনে পাশে থাকা — সব কিছু ছাপিয়ে গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে ওঠে। ততক্ষণে, সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছিলেন সুলতা। ঠিক তখনই এ দিকে ফিরে আসার উপায় ছিল না। ফলে আর কোনও দিন দেখা হবে কি না সেই সংশয় নিয়ে যে যার মতো বাড়ি ফিরে যান।

কিন্তু ঢাকায় ফিরে আবার শুরু হয় স্বামীর অত্যাচার। কাজীর মাধ্যমে তালাক নেন সুলতা। পরের বছর ২০১৬ সালের মার্চে ফোন করেন মনোজকে। ফিরতে চান তাঁর কাছে। ১০ মার্চ আবার বেআইনি ভাবে দালাল ধরে সীমান্ত টপকে ভারতে চলে আসেন সুলতা। ৩০ মার্চ জামতাড়ায় বিয়ে হয় তাঁদের। আয়ুষের সঙ্গে সুলতার ভাব হতে বেশি সময় লাগেনি। আত্মীয়দের শত আপত্তি সত্ত্বেও হাসিমুখে বৌমাকে মেনে নেন মনোজের বাবা-মাও।

মনোজকে বিয়ে করে ততদিনে সুলতা বেগম হয়ে গিয়েছেন সুলতা সিংহ। পাসপোর্ট তৈরি হয় ওই নামেই। বাংলাদেশে রেখে আসা মেয়ে ও মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে সুলতার জন্য সে দেশের ভিসাও তৈরি হয়। মে মাসের শেষ দিনে কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার বিমানের টিকিট কেটে দেন মনোজ। কিন্তু অভিবাসন অফিসারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে ধরা পড়ে যান সুলতা। আদতে বাংলাদেশি নাগরিক, ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে বেআইনি ভাবে ঢাকা যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, এই অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষমাণ মনোজকেও গ্রেফতার করা হয় সুলতাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য।

আপাতত জামিন পেয়ে দু’জনে ডুবেছেন সংসারে। যে সংসারটা যে কোনও দিন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladesh Bangaon Border সীমান্ত
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE