জি৭ বা এসসিও-র বিবৃতিতে যা হয়নি, অবশেষে ব্রিকসে এসে সেটাই সম্ভব হল।
কানাডায় জি৭ সম্মেলন বা চিনে এসসিও গোষ্ঠীর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকের পরে বিবৃতিতে পহেলগাম কাণ্ডের উল্লেখ ছিল না। কিন্তু ব্রাজ়িলের রিয়ো ডি জেনিরোয় ব্রিকস সম্মেলনের মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সন্ত্রাস-প্রশ্নে কড়া অবস্থান নেওয়ার পরে বিবৃতিতে পহেলগামে জঙ্গি হামলার কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। সন্ত্রাস দমনে ‘জ়িরো টলারেন্স’ বা শূন্য সহনশীলতার কথাও বলা হয়েছে। একই সঙ্গে নাম না করে সমালোচনা করা হয়েছে পাকিস্তানের। বার্তা দেওয়া হল চিনকেও।
আজ সম্মেলনটিতে যোগ দিতে রিয়ো ডি জেনিরো-র মিউজ়িয়াম অব মডার্ন আর্ট-এ পৌঁছন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ব্রাজ়িলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা অভ্যর্থনা জানান তাঁকে। এর পরে মোদী বলেন, ‘‘সন্ত্রাসের নিন্দা করা আমাদের নীতি হওয়া উচিত। নিজেদের সুবিধা দেখে সন্ত্রাসের নিন্দা করা উচিত নয়।’’ ব্রিকস মঞ্চে উপস্থিত রাষ্ট্রনেতাদের মোদী বলেন, ‘‘ভারত সন্ত্রাসের শিকার। পাকিস্তান সন্ত্রাসের মদতদাতা। তাই দু’দেশকে একই মাপকাঠিতে ফেলা ঠিক নয়।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, অনেকেই নিজের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক সুবিধের জন্য সন্ত্রাস নিয়ে চুপ করে থাকেন।
এর পরে প্রকাশিত বিবৃতিতে ব্রিকসের তরফে বলা হয়, ‘আমরা ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরে হওয়া জঙ্গি হামলার কড়া নিন্দা করছি। আমরা সন্ত্রাস প্রসঙ্গে শূন্য সহনশীলতার নীতি নেওয়ার আর্জি জানাচ্ছি। আমাদের মতে, সন্ত্রাসের মোকাবিলায় দ্বিচারিতা করা উচিত নয়। আন্তর্জাতিক আইন মেনে রাষ্ট্রগুলির সন্ত্রাসের মোকাবিলা করা উচিত।’ ব্রিকসের তরফে জানানো হয়েছে, সব ধরনের সন্ত্রাসের মোকাবিলায় ওই গোষ্ঠীর মধ্যে সহযোগিতা আরও বাড়ানো হবে। তার মধ্যে রয়েছে সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গিদের যাতায়াতের বিষয়টিও। পাশাপাশি রাষ্ট্রপুঞ্জের তালিকায় থাকা সব জঙ্গি ও জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার আহ্বান জানানোহয়েছে বিবৃতিতে।
কূটনীতিকদের মতে, জি৭ ও এসসিও বৈঠকের পরের বিবৃতিতে পহেলগামের উল্লেখ না থাকায় ব্রিকসের বিবৃতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এই সম্মেলনে এই শীর্ষ সম্মেলনটিতে সশরীর উপস্থিত নেই চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শি পাঠিয়েছেন চিনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্যচিয়ং-কে। পুতিন ভিডিয়ো মাধ্যমে যোগ দেবেন।
কূটনীতিকদের একাংশের মতে, পহেলগামে জঙ্গি হামলার পরে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময়ে পাকিস্তানের পাশে ছিল চিন। রাষ্ট্রপুঞ্জেও মাসুদ আজ়হারের মতো সন্ত্রাসবাদীকে জঙ্গি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে চিন বারবার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে চিন যে মঞ্চের সদস্য, সেই মঞ্চের বিবৃতিতে সন্ত্রাস প্রশ্নে দ্বিচারিতার বিরোধিতা নিঃসন্দেহে ভারতের কূটনৈতিক সাফল্যের ইঙ্গিত।
পাশাপাশি ওই মঞ্চ থেকে মোদী আমেরিকাকেও বার্তা দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবারই ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতির কৃতিত্ব দাবি করে দু’দেশকে একই বৃত্তে এনে ফেলেছেন।
অন্য দিকে, ফুটবল আর কফির দেশ ব্রাজ়িলের এই বৈঠকে যোগ দিয়ে মোদী বলেছেন, ‘‘ব্রাজ়িলের নেতৃত্বে ব্রিকস নতুন পথ চলার শক্তি পেয়েছে। এই নতুন শক্তি শুধুমাত্র এসপ্রেসো নয়, ডাবল এসপ্রেসো শট!’’ গ্লোবাল সাউথের প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী অভিযোগও করেছেন, ‘‘গরিব এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলি উন্নয়ন, সম্পদের বণ্টন, নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলিতে দ্বিচারিতার মুখোমুখি হয়। পরিবেশের ক্ষেত্রে পুঁজির জোগানই হোক বা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন— গ্লোবাল সাউথকে নাম মাত্র বরাদ্দদেওয়া হয়।’’
মূলত, আমেরিকার সঙ্গে পাঞ্জা কষতে পারে, এমন শক্তি হিসাবে ভূ-রাজনৈতিক পরিসরে মাথা চাড়া দিয়েছে ব্রিকস। চলতি বছরে যার তাৎপর্য অনেকটাই। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে বিশ্ব জুড়ে শুল্ক নিয়ে একটা চাপ তৈরি হয়েছে। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির প্রভাব সরাসরি পড়েছে ব্রিকস গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির নাগরিকদের উপরেও। ব্রিকসের বিবৃতিতে একতরফা শুল্ক ও শুল্ক-বহির্ভূত ব্যবস্থা চালু করা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)