কেন্দ্রে-রাজ্যে গেরুয়াবাহিনী এখন শাসন ক্ষমতায়। ক্ষমতাচ্যুত পুজোর মূল পৃষ্ঠপোষক, কংগ্রেসি নেতা-মন্ত্রীরা। এবং তার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়েছে বরাকের শারদোৎসবে। পুজো আয়োজকদের মাথায় হাত, মোটা অঙ্কের চাঁদা মিলবে কোথা থেকে! আগে কংগ্রেসি নেতা-মন্ত্রী, ঠিকাদাররাই ভরসা ছিলেন। কিন্তু এখন? আর তা ভেবেই ভেবে উধারবন্দের ‘উত্তরপাড়া পূজারীবৃন্দ’ রীতিমতো হতাশ।
এমনিতে এখানকার পুজো অবশ্য কম-বাজেটেই হতো। ২০১৪-য় ছবিটা বদলে যায়। সে বার ছিল ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের পুজো। পূজারীবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিল, পুজো হবে বড় বাজেটে। আয়নার টুকরোয় মণ্ডপ-প্রতিমা হয়েছিল সে বছর। বিভিন্ন পৌরাণিক বিষয় তুলে ধরা হয় মণ্ডপ ঘিরে। বাজেট লাফিয়ে বেড়ে ছিল, ৩০ লক্ষ টাকা। আর একবার বড় পুজো করলে যা হয়! উত্তরপাড়ার পক্ষেও পুরনো জায়গায় ফেরা সম্ভব হয়নি। গত বছর বাজেট কমানো হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা। তবে মণ্ডপ-প্রতিমা দেখে সেই আর্থিক কাটছাঁট আম-দর্শণার্থীর বোঝার উপায় ছিল না। বিভিন্ন রকমের মশলায় মূর্তি গড়া হয়েছিল। মণ্ডপ ছিল চেন্নাই রামকৃষ্ণ মঠের আদলে।
‘‘কিন্তু এ বার আর বড় বাজেট ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ১৫ লক্ষ টাকায় পুজো সারতে হবে আমাদের।’’—খোলাখুলিই জানিয়ে দিয়েছেন পুজো কমিটির অন্যতম কর্মকর্তা বিষ্ণুপদ পাল। গত দু’বছর ধরে তিনিই ছিলেন সম্পাদকের দায়িত্বে। এ বার নিত্যানন্দ পালকে সভাপতি এবং বিশ্বজিত পালকে সম্পাদক করা হলেও সব কিছুর নেপথ্যে বিষ্ণুবাবুই।
সরকার বদলের কথা সরাসরি না বললেও বিষ্ণুপদ পালের বক্তব্য: বাজেট কমানোর বহু কারণ রয়েছে। প্রথমত, নির্বাচনের বছর বলে যাঁরা মোটা টাকা চাঁদা দিতেন সেই সব ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা নেই। নতুন সরকার সবে বাজেট তৈরি করেছে। এখনও কাজকর্ম শুরু হয়নি। বাজারে টাকা আসেনি। সুতরাং ঠিকাদাররাও হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, পাথর খাদানের ওপর উধারবন্দের অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দীর্ঘদিন থেকে খাদানগুলি বন্ধ। ফলে এ কাজে জড়িত বহু লোকের কাজ নেই। পাথরবোঝাই গাড়ির চলাচলও কমে গিয়েছে। কমে গিয়েছে পুজোর চাঁদা। তৃতীয়ত, প্রাক্তন মন্ত্রী অজিত সিংহ, গৌতম রায়-রা আগে ভাল চাঁদা দিয়েছেন। এ বার আর ততটা পাবেন না।
তবে তিনি আশাবাদী, এ বারও তাঁদের মণ্ডপ-প্রতিমা দর্শক টানবে। প্রতিমা গড়ছেন স্বপন পাল। পাটের প্রতিমা। পোশাক, অলঙ্কার সবই হবে পাটে তৈরি। এমনটা আগে আর কখনও এই অঞ্চলে হয়নি বলেই দাবি বিষ্ণুপদবাবুর। তিনি বলেন, এর আগে এই অঞ্চলে পাটের কাজ বহু হয়েছে ঠিকই, তবে এটি স্বপন পালের অন্য ধরনের শিল্পকর্ম। এ ছাড়া, মণ্ডপ হচ্ছে কাল্পনিক মন্দির। সেখানেও অভিনবত্ব আনছেন করিমগঞ্জের শিল্পী রাজু বণিক। থাকবে আলোকসজ্জাও।
যেখানে যত কাটছাঁটই হোক, তিনদিনের অন্নপ্রসাদ বিতরণে যে তাঁরা বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করতে চান না, তা জানিয়ে দিয়েছেন সম্পাদক বিশ্বজিত পাল।
উত্তরপাড়ার অনেকেরই অবশ্য বাজেট কম নিয়ে আক্ষেপ নেই। দীর্ঘ দিন ধরে এই পুজোয় সক্রিয় থাকা উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ভাস্কর দাস জানান: ঐতিহ্যই আমাদের গর্ব। সরস্বতী পুজোর সাফল্যের সূত্র ধরে উত্তরপাড়ায় সর্বজনীন দুর্গাপূজার সূচনা হয়।
সেটা ১৯৬৫ সাল। প্রথম পুজো হয় সত্যেন্দ্র দেবরায়ের বাড়ির সামনে। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বনমালী রায়, সত্যেন্দ্র দেবরায়, অপূর্ব এন্দ, গুরুচরণ পাল, প্রমোদচন্দ্র পাল, ভূপেন্দ্রচন্দ্র দাস, মনীন্দ্র চন্দ্র দেব, গিরীন্দ্র বিশ্বাস, নেপুর শীল, উপেন্দ্র দেবরায়, প্রবীর শীল, উপেন্দ্র মালাকার, অখিল দে, অমলরঞ্জন এন্দ, পরেশচন্দ্র দে, রাধারমন রায়, মাখন চন্দ প্রমুখ। তাঁদের অনেকেই এখন প্রয়াত। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাই ছিলেন তখন চাঁদার মূল উৎস। চণ্ডীঘাট, লারসিং, বরসিঙ্গা, অরুণাবন্দ, কুম্ভা, কুম্ভীরগ্রাম, আরকাটিপুর, দয়াপুর, হাতিছড়া, ডলু, বিক্রমপুর প্রভৃতি চা বাগান থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করা হতো।
ছোটবেলার কথা উল্লেখ করে বছর পঞ্চাশের ভাস্করবাবু বলেন, মণ্ডপে গ্রামোফোনে হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাইক বাজানো হতো। পুরনো দিনের উল্লেখ রয়েছে দু’বছর আগে প্রকাশিত, সুবর্ণজয়ন্তী স্মরণিকাতেও। তাতে প্রথম পুজোর সঙ্গে জড়িত অমলরঞ্জন এন্দ লিখেছেন, ‘‘তখন পুজোর মণ্ডপ আমরা নিজেরাই তৈরি করতাম। প্রতিমা আনা হয়েছিল ফোর্ডগাড়ি দিয়ে টেনে শিলচর পানপট্টি থেকে।’’ ৫২ বছর ধরে এই পূজায় জড়িয়ে থাকা, বহু বছরের সভাপতি হরিপদ এন্দ লিখেছেন, ‘‘আমরা উৎসাহের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী বাগান অঞ্চলে চাঁদা সংগ্রহে যেতাম।’’
স্মৃতি হাতড়ে পরেশচন্দ্র দে বলেন, ‘‘তখন এত বাড়িঘর ছিল না। সর্বজনীন দুর্গাপুজোও আশপাশে ছিল না। বাগান থেকে লোক আসত পুজো দেখতে। প্রচুর আনন্দ হতো।’’
কামাখ্যা পাল শোনান, ‘‘এখনকার মত লাইটের ব্যবহার ছিল না। হাজারি লাইটের ব্যবস্থা থাকত মণ্ডপে। উত্তরপাড়ার পুজো দেখে কখনও কখনও সনৎকুমার দাসের বাড়ির পুজোয় যেতাম।’’ ভোলা দে বললেন, ‘‘আমাকে তিনখানা শাড়ি আনতে হতো মণ্ডপসজ্জার জন্য। এখনকার মত স্ক্রিন ছিল না। রাধারানি পাল, অর্চনা এন্দ এবং পরেশ পালের বোনের কাছ থেকে শাড়ি আনতাম। নিজেরাই মণ্ডপ তৈরি করতাম।’’
শিলচর দাস কলোনির মদন দাসের ঢাক এনে বাজানো হতো, স্মরণ করেন দীপক ঘোষ। জ্যোৎস্না চৌধুরীর কথায়, ‘আগে দেখেছি, এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের অনুষ্ঠান যেমন সংকীর্তন, পালাকীর্তন, ঢপযাত্রা-সহ আরও অনুষ্ঠান চলত মাসব্যাপী।’’ অদিতি এন্দের স্মৃতিচারণ, ‘‘গানের সংকলন করা হতো খুবই সুচিন্তিত ভাবে। গানগুলি সুরে-কথায়-কণ্ঠে সমৃদ্ধ ছিল।’’ তাই বাজেট কমাতে হলেও, তিন্তা নেই। ঐতিহ্যই বড় ভরসা পূজারীবৃন্দের!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy