জয়ের পর কালিয়াগঞ্জের তৃণমূল প্রার্থীকে ঘিরে উচ্ছ্বাস দলীয় কর্মীদের। ছবি: প্রার্থী তপন দেব সিংহর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে
আতঙ্ক থেকে বাঁচতেই কি তৃণমূলের দিকে ঝোঁক? উড়িয়ে দিচ্ছে না রাজনৈতিক মহল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোড়া থেকেই এনআরসির বিরোধী। এমনকি, তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, এ রাজ্যে এনআরসি হতে দেবেন না। তাঁর কথায় বিশ্বাস করেছেন আতঙ্কিত মানুষজন। তাই এনআরসি নিয়ে বিজেপির একগুঁয়েমি এবং তার জেরে আতঙ্কের চোরাস্রোত ইভিএম-এ ঢুকে পড়াটা অসম্ভব নয় বলেই মনে করছেন নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের একাংশ। কালিয়াগঞ্জের বিজেপি প্রার্থী কমলচন্দ্র সরকার যেমন সরাসরিই বলেছেন, ‘‘এনআরসি নিয়ে মানুষকে আমরা বোঝাতে পারিনি। তাই এমন ফল।’’
প্রায় একই দাবি করেছে তৃণমূলও। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও বলেছেন, ‘‘বিজেপি কখনও এনআরসি, কখনও অন্য কিছু নিয়ে যা খুশি প্রচার করছে। এই মানুষরাই দীর্ঘ দিন ধরে ভোট দিয়েছেন, এমপি-এমএলএ বানিয়েছেন, সমস্ত কাজ করেছেন। আর এখন ওরা (বিজেপি) বলছে, নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে।’’ অর্থাৎ বিজেপির খারাপ ফল এবং তাঁদের সাফল্যের পিছনে এনআরসি অন্যতম বড় ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করেছে— মানছেন তৃণমূলনেত্রী।
আরও পড়ুন: ছ’মাসেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চাঙ্গা তৃণমূল, তোলপাড় শুরু বিজেপিতে, এনআরসির পরোক্ষ শিকার বাম-কংগ্রেসও
যদিও এখনই সে কথা মানতে নারাজ বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। যুক্তি হিসেবে তাঁরা তুলে আনছেন কালিয়াগঞ্জ এবং করিমপুরের ফলাফল। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা করিমপুরে এনআরসি আতঙ্ক ছিল বেশি। কিন্তু সেখানে বিজেপির ভোট কমার বদলে প্রায় ৫ হাজার বেড়েছে। কিন্তু বাম-কংগ্রেসের মিলিত ভোটে কার্যত ধস নেমেছে। লোকসভা নির্বাচনে দু’দলের মিলিত ভোট ছিল ৩৯ হাজারেরও বেশি। সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজারের কিছু বেশি। আবার কালিয়াগঞ্জেও বিপুল পরিমাণ ভোট কমেছে বিজেপির এমনটা বলা যাবে না। বরং তার তুলনায় বাম-কংগ্রেসের ভোট অনেক কমেছে।
অথচ খড়্গপুর সদর কেন্দ্রে, যেখানে এনআরসির তেমন প্রভাব পড়ার কথা নয়, সেখানেই বিজেপির ভোট বিপুল কমে ৯৩ হাজার থেকে কমে নেমে এসেছে ৫২ হাজারের কাছাকাছি। এনআরসির জন্যই বিজেপির এই খারাপ ফল কি না, এই প্রশ্নে দলের নেতা মুকুল রায় যেমন বলেছেন, ‘‘এখনই সে কথা বলে দেওয়া যাবে না। কেন এই ফল হল, সেটা আমরা বিশ্লেষণ করে দেখব।’’
আরও পড়ুন: বিজেপির ‘ঔদ্ধত্য-অহংকার’ মানুষ ভাল ভাবে নেয়নি, উপনির্বাচনের ফল স্পষ্ট হতেই তোপ মমতার
তবে কি শুধু এনআরসি নয়, আরও কিছু? অন্দরের কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষকরা তুলে আনছেন দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি। জিডিপি, রাজকোষ ঘাটতি, ক্রেডিং রেটিং, বিদেশি বিনিয়োগের মতো জটিল হিসেব-নিকেশ আম ভোটারদের মাথায় না ঢুকলেও, সামগ্রিক অর্থনীতি যে ধুঁকছে, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় তাঁদের। বিরোধীরাও সেটা বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। ধুঁকতে থাকা অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণের চেষ্টা চলছে। সরকারি চাকরিতেও কমছে নিশ্চয়তা। রেল, বিএসএনএল-এমটিএনএল, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে তীব্র আতঙ্ক কর্মীদের মধ্যে। নতুন শিল্প-বিনিয়োগ প্রায় নেই। ফলে কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না, উল্টে স্থায়ী চাকরিও রাতারাতি বাতিল হয়ে যাচ্ছে, এমন নজিরও রয়েছে। অর্থনীতির এই সামগ্রিক ভঙ্গুর দশা ইভিএম-এ ছাপ ফেলবে না, এমন ভাবতে নারাজ বিশ্লেষকরা।
উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে খড়্গপুরের ফল। বিজেপির ভোট কমেছে বিপুল হারে। অথচ সেখানে এনআরসির প্রভাব কার্যত নেই। রেলশহর খড়গপুরে রয়েছেন প্রচুর ভিন রাজ্যের মানুষ, তথা অবাঙালি। এই অবাঙালি সম্প্রদায়ের ভোট মূলত বিজেপির দিকেই যেত। তবে কি তাঁরাও এ বার মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন বিজেপির দিক থেকে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সে দিকেই ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘‘খড়্গপুরের অবাঙালি ভিন রাজ্যের বাসিন্দারাও আমাদের ভোট দিয়েছেন।’’
২০১৪-র পর ২০১৯-এ আরও বেশি আসন নিয়ে বিপুল জয় পেয়েছে বিজেপি তথা এনডিএ শিবির। কিন্তু সংখ্যার জোর থাকলেই দলের মতবাদকে গায়ের জোরে দেশবাসীর উপরে চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাবকে দেশবাসী ভাল ভাবে নাও নিতে পারেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কার্যত সেই মেরুকরণের চেষ্টাই করে চলেছে বিজেপি। অভিযোগ উঠেছে, এনআরসি-সহ একাধিক সিদ্ধান্তে চেষ্টা চলছে মুসলিম সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার। আবার হিন্দুত্ববাদকে জাতীয়তাবাদ হিসেবে চাপানোর চেষ্টাও চলছে নিরন্তর।
লোকসভা ভোটের পরে পরেই মোদী হাওয়ায় মহারাষ্ট্রে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে বলে আশা করেছিল বিজেপি। কিন্তু সেটা তো হয়ইনি, উল্টে ১২২ থেকে আসন কমে দাঁড়িয়েছে ১০৫-এ। শিবসেনা-বিজেপি দড়ি টানাটানিও দেখেছে গোটা দেশ। পদ্ম শিবিরের অনমনীয় মনোভাবও নজর এড়ায়নি। তার আগে কর্নাটকে কংগ্রেস-জেডিএস শিবির ভাঙিয়ে বি এস ইয়েদুরাপ্পার সরকার গঠনে ঘোড়া কেনাবেচার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন না অনেকেই।
শুধুমাত্র তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন থেকে অবশ্য গোটা দেশের সামগ্রিক রাজনীতি সম্পর্কে কোনও উপসংহারে পৌঁছনো সম্ভব নয়। সারা দেশের রাজনীতির সব প্রভাব এ রাজ্যের ভোটে এসে পড়বে, এমনটাও ভাবা ঠিক নয়। তাছাড়া প্রতিটি নির্বাচনই চরিত্রগত দিক থেকেও আলাদা হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকণা থেকে মরুভূমি সৃষ্টির মতো কে বলতে পারে, এই তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচনও হয়ে উঠতে পারে বৃহত্তর রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের সূচনা বা পূর্বাভাস।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ