—ফাইল চিত্র।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যা পারেননি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেটা পারলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঢাকায় নিয়ে যেতে সক্ষম হননি মনমোহন। সক্ষম হয়েছেন মোদী। কিন্তু কী ভাবে? প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য কারণ একটাই। সেটা হল, তাড়াহুড়ো করে ঢাকা না গিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গত এক বছর ধরে তিনি তিল তিল করে হোমওয়ার্ক করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিভিন্ন দূত মারফত আলাপ-আলোচনা চালিয়েছেন। বরফ গলানো সম্ভব হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ সফর চূড়ান্ত করেছেন। বেশ কিছু দিন আগে মোদীকে প্রশ্ন করেছিলাম, সব প্রতিবেশী রাষ্ট্র যাচ্ছেন, বাংলাদেশ যাচ্ছেন না কেন? প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ভুটান গিয়েছেন, তার পর নেপাল, শ্রীলঙ্কা গিয়েছেন। এমনকী আসন্ন জানুয়ারিতে সার্ক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তান যাওয়ার কথা। মোদী জবাবে বলেছিলেন, “আগে দেশের ভিতরে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদের জায়গাগুলি সমাধান করা প্রয়োজন। তার পর বাংলাদেশ যাওয়া উচিত।” আসলে খালি হাতে যেতে চাননি মোদী। বাংলাদেশ কিঞ্চিত্ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারে কি তা হলে বাংলাদেশ নেই?— এমন একটা প্রশ্ন ঢাকার সংবাদমাধ্যমে নানা ভাবে উঠছিল। এ বার ঢাকা সফর করে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন, যে তিনি সফরের জন্য সফর করতে চাননি। চুক্তি রূপায়নের জন্য তিনি বদ্ধপরিকর।
আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামলানোর জন্য তাঁর ব্যাকরণ বোঝাটা খুব বেশি জরুরি। মনমোহন তাঁর ক্যাবিনেটে তিস্তা চুক্তি অনুমোদন করতে চেয়েছিলেন মমতার সঙ্গে আলোচনা না করেই। যে দিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপিত হয়, সে দিন দীনেশ ত্রিবেদী ছিলেন মমতার রেলমন্ত্রী। তত্কালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণববাবু তাঁকে বুঝিয়ে এটি চুপচাপ পাশ করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। মন্ত্রিসভার বৈঠক বসার আগে দীনেশ যখন মমতাকে জানান, তিনি তখন তাতে গুরুতর আপত্তি করেন। সে দিন মন্ত্রিসভা তিস্তা চুক্তি পাশ করতে পারেনি।
সংবিধান অনুযায়ী রাজ্য সরকারের অনুমোদন ছাড়াই কেন্দ্র মন্ত্রিসভার যে কোনও সূচি পাশ করাতে পারে। মনমোহন ও প্রণব তাই ভেবেছিলেন যে, রাজ্য সরকারের অনুমোদন নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাজ্য সরকার নয়, তৃণমূল তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করে। আর দীনেশ মন্ত্রিসভার সদস্য হলেও আসলে তৃণমূলেরই প্রতিনিধি ছিলেন। মোদী তাই গায়ের জোরে চুক্তি পাশ না করিয়ে মমতাকে বোঝানোর চেষ্টা শুরু করেন। মনমোহন তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন, বিদেশ সচিব রঞ্জন মাথাইকে মমতার কাছে পাঠিয়েছিলেন। মোদী কিন্তু অন্য কোনও প্রতিনিধি না পাঠিয়ে নিজে মমতার সঙ্গ কথা বলেন বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। রাষ্ট্রপতি ভবনে মমতার সঙ্গে মোদীর প্রথম সাক্ষাত্ হয় এক নৈশভোজে। ঘটনাচক্রে এই নৈশভোজটি ছিল বাংলাদেশরই রাষ্ট্রপতির সম্মানে। সেখানে মোদী-মমতার কুশল বিনিময় হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মতার কথাবার্তা হয়। এমনকী নিরাপত্তা উপদেষ্টাও মমতার সঙ্গে অনেক কথা বলেন বাংলাদেশ নিয়ে। শুধু মমতা নয়, নিজের দল বিজেপির অসম শাখা স্থল সীমান্ত চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। সেই মমতাই এই চুক্তি সমর্থন করলেন। কারণ মোদী বিষয়টি বোঝাতে সমর্থ হন এবং বাংলাদেশ সফরের আগে ছিটমহলের উন্নয়নে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রের তরফে চিঠি দিয়ে রাজ্যকে জানানো হয়। মোদীর সঙ্গে মমতার একান্তে দু’টি বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠকটি হয় সংসদ ভবনের ঘরে। দ্বিতীয়টি হয় কলকাতার রাজভবনে। ওই দু’টি বৈঠকেই বাংলাদেশ নিয়ে মোদী মমতার সঙ্গে কথা বলেন। তৃতীয়টি হয় ঢাকায় শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আগে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস অদূর ভবিষ্যতে তিস্তা চুক্তিও রূপায়িত হবে। এই চুক্তি সমস্যার জটিলতা দূর করার দায়িত্ব মমতাকেই দিয়েছেন মোদী। রাজ্যের মুখ্য সচিব সঞ্জয় মিত্র, মমতার সচিব গৌতম সান্যাল, কেন্দ্রীয় বিদেশসচিব জয়শঙ্কর এবং প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত সচিব ভাস্কর খুলবে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন। কী ভাবে এই চুক্তির সমাধান হতে পারে তা নিয়েও আলোচন শুরু হয়েছে। মমতা নিজেও জানিয়েছেন যে, তিনি তিস্তা চুক্তির বিরুদ্ধে নন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চিত হতে দেবেন না। এ বার মোদী চুক্তিটাকে এমন ভাবে রূপায়িত করতে চাইছেন যাতে পশ্চিমবঙ্গ বঞ্চিত না হয়। মোদী-মমতা মিলে তিস্তা চুক্তির পথনির্দেশিকা তৈরি করছেন।
মমতাকে প্রধানমন্ত্রী ঢাকাতেও যে গুরুত্ব দিলেন সেটাও অভূতপূর্ব। সোনারগাঁও হোটেলে একান্ত নিজের গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে গেলেন হাসিনার বাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে বসার অভিজ্ঞতা মমতার এই প্রথম। এই ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়ন তৈরি করাটাই নরেন্দ্র মোদীর কৃতিত্ব। আমার অভিজ্ঞতা বলে, রাজনীতি এবং কূটনীতিতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল হলে অনেক বড় এবং শক্ত কাজ সহজ হয়ে যায়। আর সম্পর্ক খারাপ হলে অনেক ছোট কাজও বাস্তবায়িত হতে চায় না। মোদী তাই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কটাকে বিরোধের জায়গা থেকে মৈত্রীর জায়গায় নিয়ে গিয়ে কূটনৈতিক বার্তা বাংলাদেশের কাছে দিতে সমর্থ হলেন। বাংলাদেশের মানুষও মনে করল যে, মমতা যখন প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী রাজি হয়েছেন তা হলে আগামী দিনে তিস্তা চুক্তি অসম্ভব নয়।
শীত যখন এসেছে, তখন বসন্ত অবশ্যই আসবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy