পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাবে শুধুমাত্র সামরিক বা দু’তিনটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপই নয়। দীর্ঘমেয়াদি ভাবে বহুস্তরীয় কূটনৈতিক এবং কৌশলগত প্রয়াসের কথা ভাবছে সাউথ ব্লক। কী ভাবে তা বাস্তবায়িত করা যায় তা নিয়ে সামগ্রিক পর্যালোচনা চলছে।
ইইউ-এর দেওয়া বাণিজ্যে ‘বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের’ তালিকা থেকে পাকিস্তানকে সরানো, মাদক আমদানি (আফগানিস্তান থেকে) বন্ধ করিয়ে সে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভাঙা, পাক মদতপ্রাপ্ত হক্কানিদের কাবুলে একঘরে করে ফেলা, হাজারা-আহমেদিয়ার মতো বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ রেখে ইসলামাবাদকে দুর্বল করা, পাক অধিকৃত কাশ্মীরের অস্থিরতায় ইন্ধন জোগানোর মতো বিষয়গুলি বিবেচনার মধ্যে রয়েছে। তবে সবই একসঙ্গে নয়, সময় ও সুযোগ বুঝে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির সঙ্গে সংযোগ রেখেই যা করার করা হবে বলে জানা গিয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রের মতে, সন্ত্রাসবাদ ধ্বংস করতে হলে মদতকারীদের অর্থনীতি গুঁড়িয়ে দেওয়াটাই অগ্রাধিকার। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেওয়া হয়েছে। আকাশ এবং জলপথে সংযোগ ছিন্ন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডারের আগামী বৈঠকে পাকিস্তান যাতে নির্ধারিত অর্থসাহায্য না পায়, তার জন্য কথাবার্তা শুরু করেছে সাউথ ব্লক। এর পাশাপাশি ইইউ-এর দেওয়া জিএসপি (জেনারালাইজ়ড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্স) মর্যাদাপ্রাপ্ত রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের নামটি খারিজ করার চেষ্টাও শুরু হতে পারে। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদীদের পুঁজি সরবরাহের উপর নজরদারি সংস্থা এফএটিএফ-এর ধূসর তালিকায় ইসলামাবাদকে ফেরত পাঠানোর জন্য সক্রিয়তা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। এই দু'জায়গাতেই পহেলগাম কাণ্ডকে তুলে ধরা হচ্ছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের মাদকজনিত অপরাধ সংস্থা (ইউএনওডিসি) ইতিমধ্যেই হেরোইন তৈরিতে কাজে লাগে এমন কাঁচা মালের ৯০ শতাংশ নিষিদ্ধ করেছে। পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই এই কাঁচামাল পাচার ও উৎপাদনের চক্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত। সেই বিপুল অর্থে ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসের একটি বড় অংশ লালিত হয়। এই মাদক চক্রের বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর যুদ্ধ ঘোষণা করাটাও ভারতীয় সেনার চিন্তাভাবনার মধ্যে রয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনী, উপকূল রক্ষীবাহিনী এবং অন্যান্য সংস্থা সমুদ্রপথে মাদক চোরাপাচার আটকাতে পারলে আইএসআই-এর সন্ত্রাসের জালকে দুর্বল করা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নয়াদিল্লির জন্য আশার কথা, ডুরান্ড লাইন বরাবর তালিবানদের সঙ্গে এখন রক্তক্ষয়ী সংঘাতে লিপ্ত পাকিস্তান। অথচ তালিবানদের একসময় তারাই মদত জুগিয়েছিল। আস্থাযোগ্য তৃতীয় পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে তালিবানদের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার কাজ শুরু করে দিয়েছে সাউথ ব্লক। প্রসঙ্গত পহেলগাম হামলার আগে থেকেই কাবুলের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির কাজ শুরু হয়েছিল। তাই এই আপৎকালীন সময়ে তা আরও কার্যকরী হবে বলেই মনে করছেন বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা। আইএসআই-এর সমর্থনপুষ্ট হক্কানি নেটওয়ার্ককে একঘরে করে দেওয়ার চেষ্টাও চলছে। ইরানের সাহায্যে বালুচিস্তানেও এই একই কাজ করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। একই সঙ্গে পাকিস্তান-তুরস্ক-মালয়েশিয়া যে অক্ষ তৈরি হয়েছে, সে দিকেও বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়ে রয়েছে পাকিস্তান। হাজারা এবং আহমেদিয়া গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত সে দেশে অস্থিরতা তৈরি করে রেখেছে। কারণ না দেখিয়ে গ্রেফতার, অপরহরণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে পাক সেনা। চিনের উইঘুর মুসলিমদের মতোই এই সম্প্রদায়গুলির সঙ্গে কূটনৈতিক নৈকট্য তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। প্রসঙ্গত, পহেলগাম কাণ্ডের পর উইঘুরের কাছ থেকে ভারতের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বিবৃতিও এসেছে। পাক অধিকৃত কাশ্মীর, গিলগিট-বালটিস্তানে যে রাষ্ট্রবিরোধী স্বর শোনা যাচ্ছে তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছে সাউথ ব্লক। পাকিস্তানের পঞ্জাবি-গরিষ্ঠ সেনাবাহিনীর অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এই অংশের ক্ষোভকে চাইলে কাজে লাগানো সম্ভব বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের ভিত ভারতে গড়েছিলেন, সে কথাও এই প্রসঙ্গে উঠে আসছে।
সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের ভূমিকা আগামী দিনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগসূত্রের বিষয়টি এই মঞ্চে সবিস্তারে, বিশ্বাসযোগ্য ভাবে পর্যাপ্ত নথি-সহ তুলে ধরার চ্যালেঞ্জ সামনে। আর এই কাজে পাক-বন্ধু চিনকে কোনও ভাবে সঙ্গে রাখা বা প্রশমিত করে রাখা যায় কি না, তা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট পথে কাজ শুরু হয়েছে বলে সাউথ ব্লক সূত্রের খবর।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)