রানাঘাট, হিসার, জব্বলপুর, নবি মুম্বই....! সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে!
যত দিন যাচ্ছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনায় দেশের মানচিত্রে উঠে আসছে একের পর এক নতুন নাম। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে বুঝতে পেরেই আজ মুখ খুললেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। দেশ জুড়ে এই ধরনের ঘটনা রুখতে রাজ্যগুলিকেও আরও তৎপর হওয়ার জন্য আবেদন জানান তিনি। সংখ্যালঘু সমাজকে সব ধরনের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের সংখ্যালঘু কমিশনগুলির বার্ষিক আলোচনাসভায় রাজনাথ আজ বলেন, “সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর। এর জন্য ধর্মান্তরণ বিরোধী আইনের কথা ভাবছে কেন্দ্র। ওই আইন কার্যকর হলে ‘ঘর ওয়াপসি’ বা ধর্মান্তরণ নিয়ে বিতর্কে ইতি টানা সম্ভব হবে।”
ধর্মান্তরণ আইন প্রণয়ন সময়সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে যে ভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে তাতে রীতি মতো অস্বস্তিতে কেন্দ্র। রানাঘাট কাণ্ডে যে ভাবে বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনীকে নিগ্রহ করা হয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে তা বিলক্ষণ জানেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ এ দেশে সংখ্যালঘুদের উপর কোনও হামলার ঘটনা ঘটলে বর্হিবিশ্বের কাছে তার দায়ভার নিতে হবে মোদী সরকারকেই। যেমনটি নিতে হচ্ছে রানাঘাট কাণ্ডেও। রাজ্য স্তরে ঘটনার পিছনে পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা নিয়ে রাজনৈতিক ভাবে যতই আক্রমণ করুক বিজেপি, আন্তর্জাতিক মহলে কিন্তু জবাব দিতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদীকেই। ইতিমধ্যেই জানুয়ারি মাসে ভারত সফর শেষে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ নিয়ে সরব হয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও।
এই পরিস্থিতিতে দেশে-বিদেশে সংখ্যালঘু সমাজের পাশে থাকার বার্তা দিতে কিছুটা দায়বদ্ধ মোদী সরকারও। আর তাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রের খবর, রানাঘাটের ওই কনভেন্ট স্কুলটিতে রাজনাথ সিংহের যাওয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে সরকারি স্তরে। কেন্দ্র যে সংখ্যালঘু সমাজের পাশে রয়েছে সেই বার্তা দিতেই রাজনাথ ওই সফর করতে পারেন বলে জানিয়েছে মন্ত্রক। এ দিকে রানাঘাট কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রুখতে সবক’টি রাজ্যের সমস্ত মিশনারি স্কুল ও গির্জায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। যেখানে নিরাপত্তা নেই সেই স্থানগুলির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে রাজ্য সরকারগুলিকেও নির্দেশ দেয় কেন্দ্র।
কিন্তু নির্দেশ পাঠানোই সার। তাতেও যে বিশেষ লাভ হয়নি তা বুঝিয়ে দিয়েছে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর ও নবি মুম্বইয়ে দু’টি গির্জায় হামলা। ঘটনাচক্রে দু’টি রাজ্যেই বিজেপির সরকার রয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রে কোনও ভাবেই রাজ্যের ঘাড়ে দায় ঠেলতে পারছে না বিজেপি নেতৃত্ব। যদিও ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রুখতে আজ ফের রাজ্যগুলিকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন রাজনাথ। নিজের বক্তব্যে রাজ্যগুলিকে এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেন তিনি। রাজনাথ বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয় হলেও, ভগবানের নামে শপথ করে বলছি, কেন্দ্র সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর।”
রাজনাথ রাজ্যগুলিকে কড়া ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলেও, দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে নরম মনোভাব দেখানোর অভিযোগ উঠেছে খোদ বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রের সরকারের বিরুদ্ধে। গত শনিবার নবি মুম্বইয়ের একটি গির্জায় পাথর ছুড়ে পালায় মুখোশধারী তিন জন। অপরাধীদের এখনও চিহ্নিত করতে না পারায় অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীদের নামে মামলা করেছে পুলিশ। এরই মধ্যে এই ঘটনায় রাজনৈতিক হাত থাকতে পারে বলে আজ নতুন করে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন রাজ্যের সংখ্যালঘু দফতরের মন্ত্রী একনাথ খাড়সে। দু’দিন কেটে যাওয়া সত্ত্বেও দুষ্কৃতীরা অধরা। অন্ধকারে পুলিশও। তার উপর সরকার বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করছে, এই অভিযোগে সোমবার মহারাষ্ট্র বিধানসভা থেকে ওয়াক আউট করেছে বিরোধীরা। প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশকে কড়া বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস। ৪৮ ঘণ্টায় অপরাধীদের খুঁজে বার করতে হবে, সাফ জানিয়েছেন তিনি। তবে আরেক বিজেপি-শাসিত রাজ্য মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে ক্যাথিড্রালে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে হামলকারীরা। আজ ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে অন্য এক গোষ্ঠীর ছ’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযোগ, এরা সকলেই ধর্ম সেনা দলের সদস্য। তবে ওই গির্জায় হামলা এই প্রথম নয়। ২০০৮ সালেও এক বার আক্রমণের মুখে পড়ে ওই গির্জা। দাবি ছিল, আদিবাসীদের জোর করে ধর্মান্তরণের চেষ্টা হচ্ছিল। গির্জা কর্তৃপক্ষ যদিও ধর্মান্তরণের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ধর্মান্তরণ-বিবাদ রুখতে ‘ধর্মান্তরণ বিরোধী আইন’ আনার পক্ষে সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপির একটি অংশ। যদিও আগে সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে ধর্মান্তরণের অভিযোগ ওঠায় গোটা শীতকালীন অধিবেশন কার্যত ভেস্তে যায়। পরে চাপের মুখে ওই প্রক্রিয়ায় সাময়িক ইতি টানে সঙ্ঘ। সঙ্ঘ পরিবার মনে করে, বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে ধর্মান্তরণ করানো চালু রয়েছে।
সঙ্ঘের একাংশের আশঙ্কা এর ফলে ভবিষ্যতে এ দেশে হিন্দুদের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে যাবে। কেননা সংখ্যালঘুরা যে ভাবে একজোট, এ দেশে হিন্দুরা সে ভাবে একজোট নয়। সে কারণেই হিন্দু সমাজ কখনই এক স্বরে ধর্মান্তরণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারছে না। তাই এখন থেকেই আইন করে ধর্মান্তরণ রুখতে চাইছে সঙ্ঘ। তারা মনে করে, একমাত্র আইন করেই এই ধর্মান্তরণ রোখা সম্ভব। নচেৎ নয়। সঙ্ঘ চায় বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে কড়া অবস্থান নিক কেন্দ্র। দ্রুত এ বিষয়ে আইন আনা হোক। আজ সংখ্যালঘু কমিশনের বৈঠকে যে ভাবে রাজনাথ বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন তার পিছনে সঙ্ঘের প্রভাব রয়েছে বলেই মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। আজ রাজনাথ বলেন, “অন্য দেশে সংখ্যালঘুরা নিজেদের অস্বিত্বের তাগিদে ওই আইন আনার পক্ষে। কিন্তু এ দেশে সরকার ওই আইন আনতে চায়। সংসদে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে। তাঁরা চাইছেন সরকার এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ করুক। দেশের মানুষ এখন আলোচনা করে ঠিক করুক তারা এই আইন চান কিনা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy