দুলারি যখন কোচ।—পার্থ চক্রবর্তী
তাঁরও কথা ছিল রানি ডিসপোট্টা হয়ে ওঠার। রানি ডিসপোট্টা— ‘চক দে ইন্ডিয়া’র দলে ঝাড়খণ্ড থেকে আসা মেয়েটি!
৩৫ বছরের দুলারি টোপো নিজের জীবনে ‘রানি’ হতে পারেননি। অনূর্ধ্ব উনিশ রাজ্য দলে খেলতেন। অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অভাবের সংসারে খেলা ছাড়তে হয়েছে। এখন রাঁচি থেকে খুঁটি যাওয়ার রাস্তায় হরদাগ চকে চপ-শিঙাড়ার ছোট্ট দোকান চালান তিনি। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত নিজের হাতে চপ-শিঙাড়া-পান্তুয়া ভাজেন। শুধু বিকেল চারটে থেকে সন্ধে ছ’টা তাঁকে দোকানে পাওয়া যায় না।
দুলারি টোপো তখন দুলারি ম্যাডাম! হাতে হকি স্টিক! নিজের ছেলেমেয়ে তো বটেই, সেই সঙ্গে গ্রামের মাঠে উৎসাহী কচিকাঁচাদের সবাইকে হকির কোচিং করান দুলারি। দু’চোখে প্রতিজ্ঞা, নিজে পারেননি তো কী হয়েছে! তাঁর ছাত্রছাত্রীরা জাতীয় দলে খেলবেই!
দুলারির চার মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ের হকিতে সে রকম উৎসাহ নেই। বাকি ছেলেমেয়েরা খেলছে। মেজ মেয়ে কাঞ্চন কুমারী দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার কোটায় বি-কম পড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিমে চুটিয়ে হকিও খেলছেন। আর এক মেয়ে নীতু কুমারী রাঁচির বরিয়াতু হকি সেন্টারে খেলছে। রাজ্যের অনূর্ধ্ব চোদ্দো টিমেও ইতিমধ্যেই খেলেছে। দুলারির আশা, ‘‘দু’জনেই জাতীয় দলে খেলবে।’’ মায়ের কাছে থেকে খেলা শিখছে এখন ছোটো মেয়ে রানি কুমারী আর ছেলে বিজয় মাহাতো।
হরদাগ চকের কাছেই খেলার মাঠ। দোকান থেকে বিকেল চারটে নাগাদ অটো করে দুলারি চলে আসেন মাঠে। ছেলেমেয়েরা গ্রামের অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে সেখানেই অপেক্ষা করে থাকে। বছর বারোর রানি বলে, ‘‘মা হকি মাঠে খুব কড়া। এখানে মাকে চিনতেই পারি না। বারবার বলে, তোকে জাতীয় দলে খেলতেই হবে।’’ শুধু কী রানি-বিজয়? দুলারির কাছে গ্রামের সব হকি-খেলুড়েই সন্তানের মতো। যে ভাল খেলে তাকে কাছে টেনে নেন তিনি। খেলা শুরুর আগে বলেন, ‘‘যে সব চেয়ে ভাল খেলবে, সে আমার দোকানের শিঙাড়া আর পান্তুয়া পাবে।’’ কচিকাঁচারা দ্বিগুণ উৎসাহে খেলতে শুরু করে।
দোকানে বসে শিঙাড়া ভাজতে ভাজতেই দুলারি বলছিলেন নিজের হকি খেলার কথা। রাঁচির বরিয়াতু হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে খেলা শুরু। রাজ্য দলের অনূর্ধ্ব চোদ্দো থেকে শুরু করে অনূর্ধ্ব উনিশ অবধি খেলেছেন। সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি। তখন ঝাড়খণ্ড হয়নি। বিহারের হয়ে খেলতে গিয়েছেন কাশ্মীর থেকে কোয়ম্বত্তূর। সেন্টার পজিশনে খেলতেন। কিন্তু বাবা-মা এত গরিব ছিলেন যে কলেজে পড়া হয়নি। দুলারির কথায়, ‘‘খেলার জন্য রাঁচিতে ঘরভাড়া করে থাকতে হতো। সেই পয়সা ছিল না। ফলে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই আমারও বিয়ে হয়ে গেল।’’ জাতীয় দলে খেলা আর হল না। দুলারির স্বামী বছরের বেশির ভাগ সময়টাই খেতমজুরের কাজ করেন। কিন্তু স্ত্রীর লড়াইয়ে পাশেও থাকেন। দুলারি যে সময়টায় হকি শেখান, চপ-শিঙাড়ার দোকান তখন স্বামীই সামলান।
শাহরুখ খানের ‘চক দে ইন্ডিয়া’ দেখেছেন দুলারি। কবীর খানের সঙ্গে নিজের খুব মিল পান তিনি। বলেন, ‘‘কবীর খানের স্বপ্ন ছিল মেয়েদের দলকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করার। আমার স্বপ্ন আমার ছেলেমেয়েদের, আমার গ্রামের ছেলেমেয়েদের জাতীয় দলে খেলতে দেখা। আমি জিতবই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy