Advertisement
E-Paper

এ-পারে জলের পাইপ পাততেও চিনা বাগড়া

সীমান্তের গ্রামবাসীরাই নাকি প্রতিরক্ষার প্রথম প্রাচীর। কিন্তু সেই প্রাচীরেই ফুটো! কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ঘরোয়া ভাবে স্বীকার করে নিচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে জনপদ ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে চিন সীমান্তের এ পারে।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:৫৬

সীমান্তের গ্রামবাসীরাই নাকি প্রতিরক্ষার প্রথম প্রাচীর। কিন্তু সেই প্রাচীরেই ফুটো!

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ঘরোয়া ভাবে স্বীকার করে নিচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে জনপদ ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে চিন সীমান্তের এ পারে। এই এলাকাগুলিতে না রয়েছে থাকা-বাঁচার পরিকাঠামো, না আছে প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করার রসদ। তাই খাঁ খাঁ করছে জনপদ। সেই সুযোগে যখন যে ভাবে পারছে, ঢুকে আসছে চিনা সেনা। তৈরি করছে অস্থায়ী তাঁবু। বাধা দিচ্ছে ভারতের সংস্কার কাজেও। এমনকী গ্রামবাসীর তেষ্টা মেটাতে জলের পাইপ পাততে গিয়েও বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। পারদ চড়ছে সীমান্তে।

সম্প্রতি এমনই এক ঘটনা ঘটেছে লাদাখের ডেমচোক গ্রামে। সেখানে দু’দেশের সেনার উত্তপ্ত রেষারেষির জেরে দেরিতে হলেও টনক নড়েছে কেন্দ্রের। এ বার ভারত-চিন সীমান্তের বেশ কয়েকটি ‘সমস্যাবহুল’ পকেট বেছে নিয়ে সেখানে জরুরি ভিত্তিতে পরিকাঠামো প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু করতে চলেছে সরকার। লক্ষ্য, সীমান্তের গ্রামগুলিতে জনবহুল বসতি গড়ে তোলা। যে সব জনপদ সেনাবাহিনীর চোখ ও কানের মতো কাজ করবে, কার্যত শক্তিশালী প্রাচীরের মতো কাজ করবে দেশের প্রতিরক্ষায়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের খবর, এর জন্য সমীক্ষা শুরু করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। ওই চিহ্নিত পকেটগুলিতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিদ্যুদয়ন, পানীয় জল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিদ্যালয়ের মতো বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণের জন্য বিশেষ নোটও গিয়েছে অর্থ মন্ত্রকে।

সীমান্ত নিয়ে মতবিরোধ মেটাতে দু’দেশের মধ্যে ‘বিশেষ মেকানিজমে’ আলোচনা চলেছে প্রায় এক দশক ধরে। এখনও কোনও সূত্র বেরোয়নি। চিনের দাবি, ম্যাকমাহন রেখার এ পারে অরুণাচল ও বাকি সীমান্তের বিতর্কিত অংশে ভারতের হাতে থাকা বেশ কিছু ভূখণ্ড তাদের। ভারতের বক্তব্য, চিনই বরং কিছু এলাকায় এ পারের ভূখণ্ড দখলে রেখেছে। আর অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে প্রশ্নই উঠতে পারে না। ঐতিহাসিক ভাবে এটি ভারতের অঙ্গ।

তবে এই ঘোলা পরিস্থিতিতে যে ভারতকেই ভুগতে হচ্ছে, তা মেনে নিচ্ছেন বিদেশ ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের একটি বড় অংশ। মন্ত্রকের সীমান্ত বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্তার স্বীকারোক্তি, ‘‘সীমান্তের লাগোয়া এ পারের কোনও অংশে পরিকাঠামো গড়তে গেলেই চিনা সেনা (পিএলএ) নানা ভাবে সমস্যা তৈরি করে। কিন্তু ও পারে তাদের পরিকাঠামো দারুণ রকম আধুনিক। সীমান্তের সঙ্গে চিনের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ এতই মসৃণ, এ-পারে সামান্য কোনও গতিবিধি হলেই কয়েক লহমায় ঝাঁকে ঝাঁকে পিএলএ চলে আসে।’’ ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মীদের বক্তব্য, ও-পারে সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় পরিকাঠামো ভাল। জনঘনত্বও বেশি। সেখানকার জনতাকে এমন ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে, ভারতের কোনও সংস্কার-কাজ হচ্ছে দেখলেই দ্রুত খবর পৌঁছে যায় চিনা সেনার কাছে।

প্রশ্ন উঠছে, এত দিন দিল্লি কেন নিজেদের দিক গোছায়নি? সীমান্ত বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ব্যাপারে মনমোহন সরকারের মতাদর্শ ছিল আলাদা। প্রাক্তন বিদেশসচিব শ্যাম সারন সে সময়ে জানিয়েছিলেন, ‘‘নিরাপত্তাবিজ্ঞান এটাই বলে যে, সীমান্ত থেকে মূল ভূখণ্ড যত দুর্গম করে রাখা যাবে তত ভাল। তাতে মূল ভূখণ্ডে ঢুকতে শত্রুর অনেকটা সময় লাগবে। তত ক্ষণে প্রতিরোধের ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যাবে।’’

নরেন্দ্র মোদীর সরকার কিন্তু মনে করছে, প্রতিরক্ষার এই তত্ত্ব আজকের যুগে অচল। লাদাখের ডেমচোক গ্রামের অভিজ্ঞতাই তার বড় প্রমাণ। সেখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের জলসঙ্কট মেটাতে এলাকার উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে পাঁচ ইঞ্চি মোটা পাইপের লাইন পাতা হচ্ছিল। গত ২ নভেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় তিনটে জায়গায় একসঙ্গে খোঁড়ার কাজ শুরু করে সেনা, ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি) এবং কিছু গ্রামবাসী। পনেরো মিনিটের মধ্যেই রে রে করে হাজির হয় চিনা সেনা। ব্যানার তুলে ধরে প্রতিবাদ করতে থাকে তারা। সেই চিৎকার এবং প্রতিরোধের মধ্যেই খোঁড়ার কাজ চালিয়ে যাওয়া হয় সন্ধে সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত। পরের দিন বাকি কাজ করার জন্য বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেনাদল হাজির হয়। কিন্তু আবারও মিনিট পনেরোর মধ্যে হাজির হয় চিনা সেনা-কর্তারা। কাজ বন্ধ করার দাবি জানিয়ে তারা ফিরে যায়। দুপুরে তারা ফের আসে বড় বাহিনী ও গ্রামবাসীদের নিয়ে। উত্তেজনার পারদ এতটাই চড়ে যায়, যে কাজ গুটিয়ে ফিরে আসতে হয় ভারতীয় সেনাকে। প্রত্যক্ষদর্শী এক কর্তার কথায়, ‘‘গুলি না চললেও লাথি-ঘুঁষি, বেয়নেট দিয়ে আঘাতের মতো ঘটনাও ঘটে।’’ পরে দু’দেশের ফ্ল্যাগ মিটিং-এর পর নমো নমো করে পাইপলাইনের কাজ শেষ করা হয়।

দু’দেশের মধ্যে ৩,৪৮৮ কিলোমিটার সীমান্তে ৮টি এমন পকেট চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে ভারতের দুর্বলতা প্রকট। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্গম ভৌগোলিক পরিস্থিতি, অসহ তাপমাত্রা, রাস্তা ও ঘরবাড়ির অভাবে সেই জায়গাগুলিতে জনমানব খুবই কম।’’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত, এই পরিস্থিতি বদলাতে হবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক কর্তা জানাচ্ছেন, এই পরিস্থিতি বদলে ফেলতে সর্বোচ্চ স্তরে সক্রিয়তা তৈরি হয়েছে। এক কর্তার কথায়, ‘‘কবে সীমান্ত-মীমাংসা হবে তার জন্য বসে না-থেকে ফাঁকা ভূখণ্ডে যাতে মানুষ বসবাস করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। অরুণাচলপ্রদেশে এমন গ্রামও রয়েছে যেখান থেকে ‘জিরো লাইন’-এ পৌঁছাতে কম পক্ষে ৮-১০ দিন লেগে যায়।’’

Indo-China Border China Trespassing Water Demchok
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy