E-Paper

জিএসটি: ক্ষতি না মেটালে সেসে ভাগ চায় রাজ্য

কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী, জিএসটি-তে শুধুমাত্র ৫% ও ১৮%-এর দু’টি হার চালু করা এবং সাবান-শ্যাম্পু থেকে গাড়ি পর্যন্ত প্রায় সমস্ত পণ্যে জিএসটি কমার ফলে রাজস্ব আয় কমবে। তবে তার পরিমাণ মাত্র ৪৮ হাজার কোটি টাকা হবে বলে অনুমান।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৪৯

—প্রতীকী চিত্র।

ফের কেন্দ্র বনাম বিরোধী শাসিত রাজ্যের সংঘাত। এ বার বিষয় জিএসটি কমানো।জিএসটি-র বোঝা কমানোর সিদ্ধান্তের পরে মোদী সরকার তার যাবতীয় কৃতিত্ব নিতে মাঠে নেমেছে। কিন্তু করের হার কমার ফলে রাজ্যগুলি রাজস্ব আয়ে লোকসান নিয়ে অভিযোগ করলেও তাতে কর্ণপাত করছে না। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী শাসিত রাজ্য থেকে দাবি উঠল, কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রল-ডিজ়েলে সেস বসিয়ে যে আয় করছে, তার ভাগ রাজ্যকে দেওয়া হোক। না হলে অর্থ কমিশন কেন্দ্রের রাজস্ব আয়ের আরও বেশি অর্থ রাজ্যকে ভাগ করে দেওয়ার সুপারিশ করুক। এখন কেন্দ্রের ১০০ টাকা আয় হলে তার ৪১ শতাংশ রাজ্যগুলির সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। বিরোধীদের দাবি, এর পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশকরা হোক।

কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী, জিএসটি-তে শুধুমাত্র ৫% ও ১৮%-এর দু’টি হার চালু করা এবং সাবান-শ্যাম্পু থেকে গাড়ি পর্যন্ত প্রায় সমস্ত পণ্যে জিএসটি কমার ফলে রাজস্ব আয় কমবে। তবে তার পরিমাণ মাত্র ৪৮ হাজার কোটি টাকা হবে বলে অনুমান। উল্টো দিকে পশ্চিমবঙ্গ বলছে, জিএসটি-র হার কমানোর ফলে ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হবে। কেরলের দাবি, ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হবে। কর্নাটকের অনুমান, ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় কমে যাবে। শুধু এই তিন রাজ্যেরই দাবি অনুযায়ী, রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। রাজ্যগুলির অভিযোগ, রাজস্ব আয় কমলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন, পেনশন, সমাজকল্যাণের খরচ কে জোগাবে? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রধান মুখ্য উপদেষ্টা অমিত মিত্র বলেন, ‘‘জিএসটি পরিষদের বৈঠকে ১১ জন রাজস্ব লোকসানের ক্ষতিপূরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এর মধ্যে আট জন বিরোধী শাসিত রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। দু’জন মুখ্যমন্ত্রী, তাঁদের মধ্যে এক জন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের। এক জন বিজেপির মন্ত্রী লিখিত নোট দিয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে কোনও আলোচনাতেই যাননি।’’

অমিত মিত্রের দাবি, রাজ্যগুলির রাজস্ব আয়ে লোকসান পূরণ করতে কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রল-ডিজ়েলে সেস বসিয়ে যে আয় করে, তা এ বার রাজ্যের সঙ্গে ভাগ করে নিক। সেস বাবদ আয়ের পুরোটাই কেন্দ্রের কোষাগারে যায়। কেন্দ্র সেস থেকে প্রায় ২.৭ লক্ষ কোটি টাকা আয় করেছে। কিন্তু তা রাজ্যের সঙ্গে ভাগ করা হয়নি। এ বার রাজ্যগুলিকে তার ভাগ দেওয়া হোক। কেরলের অর্থমন্ত্রী কে এন বালাগোপাল বলেন, ‘‘কেন্দ্রের রাজস্ব আয়ের অন্যান্য উৎস রয়েছে। কিন্তু রাজ্যের হাতে জিএসটি-ই একমাত্র সম্বল।’’ জিএসটি-র বাইরে রয়েছে পেট্রল-ডিজ়েল ও অ্যালকোহল। অমিত মিত্রের হিসেবে, পেট্রল-ডিজ়েলের উপরে করের বেশিরভাগটাই সেস। তাঁর যুক্তি, প্রতি লিটার পেট্রলে যে কর বসে, তার ৯২% সেস। ডিজ়েলের করে ৮৮% সেস। তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, ‘‘সেস বাবদ আয়ের এক নয়া পয়সাও রাজ্যকে ভাগ দেওয়া হয় না। ২০১২ সালে কেন্দ্রের আয়ের মাত্র ৭% সেস থেকে আসত। এখন তা বেড়ে ২০% হয়েছে। গত ন’বছরে সেসের পরিমাণ ৪৬২% বেড়েছে। সেস যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কণ্ঠরোধ করছে।’’

কী বলছে মোদী সরকার?কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেন, জিএসটি কমার ফলে প্রাথমিক ভাবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির অনুমান করা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু বাস্তবে বাজারে কেনাকাটা বাড়লে জিএসটি থেকে আয় অনেক বেড়ে যাবে। রাজ্যগুলির রাজস্ব আয় লোকসানের বদলে নিট লাভ হবে। অমিত মিত্রের পাল্টা যুক্তি, বাস্তবে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাপিয়ে যাবে। এর পরে বিপুল পরিমাণ ‘ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট’-এ রাজ্যের কাছে কর ফেরতের দাবি আসবে। কারণ শ্যাম্পুতে জিএসটি কমে ৫% হয়েছে। কিন্তু শ্যাম্পু তৈরির নানা রাসায়নিকে জিএসটি ১৮%। এই সংস্থাগুলি কাঁচামালে মেটানো কর সরকারের কাছে ফেরত চাইবে। সীতারামনের যুক্তি, আগে রাজ্যগুলি মানুষের উপরে বোঝা কমানোর কথা ভাবুক, পরে রাজস্ব আয়ের কথা। জিএসটি কমানোর বিষয়ে কেন্দ্রের প্রস্তাবকে সমর্থন করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে অর্থমন্ত্রী সমস্ত রাজ্যকে চিঠি লিখেছেন। যদিও রাজনৈতিক ভাবে এর কৃতিত্ব সীতারামন থেকে বিজেপির সমস্ত মন্ত্রী-নেতারা পুরো কৃতিত্বই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দিচ্ছেন। রবিবার বিজেপি সাংসদরা নরেন্দ্র মোদীকে এ জন্য সংবর্ধনাও দেবেন। অমিত মিত্র মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই জিএসটি কমানোর প্রক্রিয়াটা শুরুই করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জীবন ও স্বাস্থ্য বিমায় জিএসটি প্রত্যাহারের দাবি তুলে।

কেরলের অর্থমন্ত্রী বালাগোপালের অভিযোগ, রাজনৈতিক কৃতিত্ব নিতে ব্যস্ত কেন্দ্রীয় সরকার রাজস্ব ক্ষতি নিয়ে আলোচনাই করতে রাজি নয়। কেন্দ্রের উচিত, এত দিন যে রাজস্ব ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ছিল, তা চালু রাখা হোক। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া আজ একই দাবি তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, তামাক-গুটখা-সিগারেটের মতো ক্ষতিপূরণ সেস চালু রেখে রাজ্যকে সাহায্য করা হোক। অমিত মিত্রের বক্তব্য, তামাক, পানমশলায় এত দিন ৬০-৭০% কর বসত। এখন সেই তুলনায় ৪০% জিএসটি বসবে। সহজেই এর উপরে বাড়তি সেস বসানো যায়। তার জন্য জিএসটি আইনের ৯ নম্বর ধারায় একটি সংশোধন করলেই চলবে। কিন্তু সীতারামনের যুক্তি, এক পয়সাও বাড়তি আদায়ের অর্থ, মানুষের উপরে ফের করের বোঝা চাপানো। তাতে জিএসটি সংস্কারের উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। ক্ষতিপূরণ সেসের মেয়াদও বাড়ানো সম্ভব নয়।

কেন্দ্রের এই অনড় মনোভাব দেখে রাজ্যগুলির দাবি, এ ক্ষেত্রে অর্থ কমিশনের সুপারিশে কেন্দ্রের আয়ে রাজ্যগুলির ভাগ বাড়ানো হোক। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে এখন কেন্দ্রের আয়ের ৪১ শতাংশ রাজ্যগুলিকে ভাগ করে দেওয়া হয়। ডেরেকের যুক্তি, কেন্দ্র সেস থেকে অনেকখানি আয় করছে। তার ভাগ রাজ্যকে দিতে হয় না। ফলে বাস্তবে কেন্দ্র আগেই ১০০ টাকা আয়ের মধ্যে ২১ টাকা নিজের পকেটে রেখে দিচ্ছে। বাকি ৭৯ টাকার ৪১% রাজ্যগুলিকে ভাগ করে দিচ্ছে। তাই ষষ্ঠদশ অর্থ কমিশনের কাছে ২২টি রাজ্য দাবি করেছে, কেন্দ্রের আয়ের ৫০% রাজ্যগুলিকে ভাগ করে দেওয়া হোক। এর মধ্যে বিজেপি শাসিত রাজ্যও রয়েছে। কেরলের অর্থমন্ত্রী বালাগোপাল বলেন, ‘‘জিএসটি-র হার কমানোর ফলে রাজ্যের আয় কমে যাওয়ায় আমাদের দাবি, কেন্দ্রের আয়ের ৬০% রাজ্যগুলির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হোক।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

GST Slabs GST Rate GST Central Government West Bengal government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy