প্রধানমন্ত্রী ফরমান দিয়েছেন। আর সরকার ফতোয়া জারি করেই খালাস। ব্যাঙ্ক আর পোস্ট অফিসে গিয়ে পুরনো ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট জমা দিয়ে নতুন নোট নিয়ে আসতে হবে। ৫০ দিনে্র মধ্যে পুরনো ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোটের বান্ডিল ঘর থেকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিতে হবে। কিন্তু ক’টাই-বা ব্যাঙ্কের শাখা রয়েছে আমাদের দেশে? রয়েছে ক’টা চালু পোস্ট অফিস? আর সুদূর গ্রামাঞ্চলে সেগুলি তো রয়েছেও বেশ কয়েক ক্রোশ দূরে। গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতেই বেলা কাবার হওয়ার জোগাড়! ফলে, প্রধানমন্ত্রীর ফরমান আর সরকারি ফতোয়ার জেরে একেবারে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে আমজনতার, ৮ নভেম্বরের ঘোষণার পর গত পাঁচ দিনে। পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি আর পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলিতে। যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলির শাখার সংখ্যাও হাতে গোনা। এমন জায়গাও রয়েছে, যেখানে বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে বিশাল একটি জায়গায় ব্যাঙ্কের শাখা রয়েছে সাকুল্যে একটি। সেই সব শাখা কখন খোলা থাকে, আর কখনই-বা থাকে বন্ধ, তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই! ফলে, টাকার অভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে মানুষের পক্ষে বাজারে গিয়ে চাল, ডাল, শাকসব্জি, আনাজপাতির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাও সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই বলছেন, কালো টাকার বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধঘোষণা’ করতে গিয়ে দেশের ‘সাদা’ মানুষের (আমজনতা)একটি বড় অংশকে বেশ খানিকটা বিপদেই ফেলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর তাঁর সরকার।
প্রশ্ন উঠছে, ঘোষণার সময় কি প্রধানমন্ত্রীর মাথায় ছিল ১২০ কোটি জনসংখ্যার দেশের মানুষের মধ্যে কত জনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, কত জনেরই বা অ্যাকাউন্ট রয়েছে পোস্ট অফিসে? কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকেরই পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৮ থেকে ৩২ শতাংশ মানুষের ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তা হলে দেশের বাকি ৬৮ থেকে ৭২ শতাংশ মানুষ তাঁদের ঘরে রাখা পুরনো ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোটের বান্ডিলগুলিকে কী ভাবেই বা বদলে নিতে পারবেন? কেন তাঁদের জন্য কোনও আপৎকালীন ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? বাস্তব এটাই যে, সাড়ে ৯ হাজার ভারতীয়-পিছু দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের শাখা রয়েছে সাকুল্যে একটি। উত্তর-পূর্বাঞ্চল সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের অন্তত ৩৮টি জেলায় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলির শাখার সংখ্যা ১০টিরও কম। দেশে যে মোট ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৬২৬টি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের শাখা রয়েছে, তার মাত্র ৩৩ শতাংশ রয়েছে ‘টায়ার-ওয়ান’ ও ‘টায়ার-টু’ শ্রেণির শহরগুলিতে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এই অসুবিধার দিকগুলির দিকেই আঙুল তুলতে চাইছেন। তাঁদের বক্তব্য, একই কারণে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঘোষিত জন-ধন যোজনা প্রকল্পটির যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেশের সবক’টি জেলার গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া এখনও সম্ভব হয়নি। ব্যাঙ্ক ও পোস্ট অফিসের শাখাগুলির দূরত্ব এবং সেই সব শাখায় গিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলার জটিলতা, সেভিংসে অল্প সুদের হার ওই শাখাগুলিতে গ্রাহকের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করেনি।
শনিবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘রাজ্যে অন্তত ৭০০ পঞ্চায়েত রয়েছে, যেখানে কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের কোনও শাখা নেই।’’
একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক। বিহারের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলির একটি পশ্চিম চম্পারন। এই জেলায় রয়েছে ১৭টি প্রশাসনিক ব্লক। তারই একটি- সিধাও। এই ব্লকে ১৫৮টি গ্রাম। ভাবুন, ১৫৮টি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা একটি ব্লকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের শাখা রয়েছে মাত্র দু’টি। পোস্ট অফিসের সংখ্যা সাকুল্যে ১৫টি। যদিও গোটা পশ্চিম চম্পারন জেলায় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের শাখার সংখ্যা ১৮৭টি। এর মানে, প্রয়োজন অনুসারে দেশের সর্বত্র রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলির শাখা গড়ে তোলা হয়নি।
যাঁরা এই ফরমান ঘোষণা করেছেন, জারি করলেন ফতোয়া, ঘটনা হল, সেই বিজেপি-ই ২০১৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের একই চেষ্টায় বাধা দিয়েছিল। ওই সময় ইউপিএ সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল, ২০০৫ সালের আগেকার ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দিয়ে নতুন নোট বাজারে ছাড়া হবে। কিন্তু মূলত বিজেপি-র বিরোধিতাতেই সেই সময় তা সম্ভব হয়নি। ওই চেষ্টার জন্য তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমকে সেই সময় ‘গরিবের স্বার্থের পরিপন্থী’ বলে সমালোচনা করেছিলেন বিজেপি নেত্রী মীনাক্ষী লেখি।
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
আরও পড়ুন- এটিএম দুর্ভোগ আজও, চলবে আরও কয়েক দিন, মানলেন জেটলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy