Advertisement
E-Paper

পানীয় জল কোথায়! ক্ষোভে ফুঁসছে পুরী

রাস্তার দু’পাশের ঝুপড়ি-হারা, ক্লান্ত, বিষণ্ণ মুখের সারি ফুঁসে উঠল আজ। পানীয় জলের দাবিতে সকাল থেকে প্রশাসনের সঙ্গে বচসায় জড়ালেন তাঁরা।

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৯ ০৩:৩৬
পানীয় জলের দাবিতে পুরীর কদলীবাড়িপটনা এলাকায় রাস্তা অবরোধ। রবিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

পানীয় জলের দাবিতে পুরীর কদলীবাড়িপটনা এলাকায় রাস্তা অবরোধ। রবিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

প্রায় জলশূন্য পুরী! তার জেরে দফায়-দফায় সাধারণ মানুষের পথ অবরোধ, বিক্ষোভ, গাড়ির টায়ার জ্বালানো— ঘূর্ণিঝড় ফণী আছড়ে পড়ার ৪৮ ঘণ্টা পরে আজ এ ভাবেই উত্তাল হল সমুদ্র-শহর!

রাস্তার দু’পাশের ঝুপড়ি-হারা, ক্লান্ত, বিষণ্ণ মুখের সারি ফুঁসে উঠল আজ। পানীয় জলের দাবিতে সকাল থেকে প্রশাসনের সঙ্গে বচসায় জড়ালেন তাঁরা। যে বিক্ষোভ-মানচিত্রে একাকার হয়ে গেল চারনালা, কদলীবাড়িপটনা, চন্দনপুর-সহ পুরী জেলার একাধিক এলাকা। পরিস্থিতি সামলাতে নাজেহাল হল পুলিশ।

পানীয় জলের সঙ্গে দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগের দাবিও তুলেছেন বিক্ষোভকারীরা। গত কাল পর্যন্ত ধৈর্য ধরে ছিলেন। জানতেন, এত বড় বিপর্যয়ে ভোগান্তি স্বাভাবিক। সরকারি আশ্বাসে ভরসাও রেখেছিলেন তাঁরা। কিন্তু ঝড়ের দু’দিন পরেও পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র উন্নতি না-হওয়ায় জমে থাকা যাবতীয় ক্ষোভ আজ নেমে এল জাতীয় সড়ক থেকে শুরু করে অলিতে-গলিতে। যার মুখে পড়ে বাড়ি-ফেরতা পর্যটকদের ভোগান্তিও উঠল চরমে।

কদলীবাড়িপটনায় রাস্তার উপরে বসে স্থানীয় মহিলারা ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলেন। ওঁরাই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এলাকায়। তাঁদের এক জন, অসীমা রাউত বলছিলেন, ‘‘অবরোধে বসেছি দেখে কে এক জন খাওয়ার জল দিল। অমনি সকলে মিলে সেই জলের গ্লাসের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অবরোধে বসেছিলাম বলেই জল খেতে পারলাম। না-হলে তো ঝড়ের পর থেকে জলের মুখ দেখতে পাইনি। বাড়িতে যেটুকু জল ছিল, সব শেষ।’’ আর এক বিক্ষোভকারী সুমিত্রা মিশ্র বললেন, ‘‘দূরে একটা মাত্র জলের কল রয়েছে। সেখানে লম্বা লাইন। বাড়িতে একফোঁটা জল না-পেয়ে বাচ্চাগুলো ছটফট করছে। কারও হুঁশ নেই!’’ পরে চোখে পড়ল, সবেধন নীলমণি সেই কলের সামনে হাঁড়ি, বালতি, বোতলের পাহাড়। একটা কলে কি আর গোটা এলাকার তেষ্টা মেটে! চারনালার বাসিন্দা সুভাষ প্রুস্তি বললেন, ‘‘ভোট হয়ে গিয়েছে। তাই এখন আর আমাদের কে দেখে! ভোট থাকলে জলের গাড়ির লাইন পড়ে যেত।’’

সরকারি তৎপরতায় লাখো প্রাণ বাঁচলেও এখানকার ন্যূনতম পরিষেবা এখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। পুরী থেকে ভুবনেশ্বর যাওয়ার গোটা রাস্তায় বারবার একটাই ছবি। পথে লুটিয়ে রয়েছে গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, ইট-পাথরের ধ্বংসস্তূপ। আর মানুষ ছুটছে উদ্‌ভ্রান্তের মতো। অজস্র মোবাইলের টাওয়ার ভেঙে, তার ছিঁড়ে পুরীর টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পথে বসিয়েছে ফণী। কবেই বা রাস্তা সাফ হবে, কবে বিদ্যুৎ আসবে, দূরের আপনজনেদের ফোনে কবে খবর দেওয়া যাবে— জানেন না কেউই! জেলা প্রশাসনের তরফে ‘দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা’র আশ্বাসকে সামান্যতম গুরুত্ব দিতে নারাজ বাসিন্দারা। এ দিকে, রাস্তাতেও পদে-পদে বিপদ। উল্টে পড়ে থাকা আলোকস্তম্ভ থেকে বিপজ্জনক ভাবে বেরিয়ে রয়েছে লোহার পাত। তার পাশ দিয়েই চলছে গাড়ি, মানুষজন। হরেকৃষ্ণপুরের মাধব মিশ্র বলছিলেন, ‘‘ঝড় হবে, সেটা তো জানাই ছিল। ঝড়ের পরে কী হবে, তা কি প্রশাসন আন্দাজ করতে পারেনি? এত যে প্রস্তুতির কথা শুনেছিলাম, সব গেল কোথায়!’’

‘‘বাড়িতে একটা মোমবাতি নেই। ভূতের মতো বসে আছে গোটা পাড়া’’, বলছিলেন স্থানীয় আর এক বাসিন্দা নরেন্দ্র পাত্র। দোকানগুলোতেও মোমবাতির ‘স্টক’ শেষ। তাই সন্ধে নামলেই প্রায়ান্ধকার পুরী! ঝড়ের পর থেকে হোটেলগুলোয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জেনারেটর চালানো হচ্ছিল ঠিকই, তাতে সমুদ্রতটের দিকে কিছুটা অন্ধকারও কেটেছিল। কিন্তু শনিবার রাতের পর থেকে তা-ও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। অন্ধকার, দরজা-জানলা ভাঙা বড়-বড় হোটেলগুলো যেন জীর্ণ প্রাসাদ। যে ক’জন হাতে গোনা পর্যটক আটকে ছিলেন, তাঁরা এ দিন সাতসকালেই কোথাও ছোট বাস, কোথাও গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়েন। যন্ত্রণা গাড়িচালকদেরও। কেউ তিন-চারটে পেট্রোল পাম্প ঘুরেও তেল না-পেয়ে দু’চোখে ভয় নিয়ে বলছেন, ‘‘এই এলাকা ছেড়ে এক্ষুনি বেরোতেই হবে।’’ কেউ কোনও মতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে গাড়ির ট্যাঙ্ক ভর্তি করার পরেও আরও তিন-চারটে জারে তেল ভরে নিচ্ছেন। আবার কোথায় জ্বালানি মেলে, কে জানে!

বাড়ির পথে পা বাড়াচ্ছেন একাধিক হোটেলের কর্মীরা। হোটেলকর্মী স্বরূপ গড়াই বললেন, ‘‘পাম্প-মোটর সারানোর মিস্ত্রিও তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা থেকেই বা কী করব! বাড়ির লোকও চিন্তা করছে। কেমন আছি, কী করছি, তারা জানেই না। বাড়ি না-ফিরে উপায় কী!’’ আর এক হোটেলকর্মী হরি রাউতের বাড়ি কোণার্কে। বলছেন, ‘‘বাড়ির কোনও খোঁজ পাচ্ছি না। ওরাও জানে না, আমি বেঁচে আছি কি না।’’

ঝড়বৃষ্টির পর থেকে আর এক যন্ত্রণা, রাস্তায়-রাস্তায় জমা নোংরা জল। আজ দেখা গেল, রাস্তার দু’ধারে জঞ্জাল পচতে শুরু করেছে। ফলে কটু গন্ধ চারিদিকে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডা কৃষ্ণচন্দ্র বলছিলেন, ‘‘চারিদিকে অন্যায়। না হলে কোনও বার এ রকম হয়নি।’’

সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা— সরকারি ভবনগুলোর ছন্নছাড়া দশা। কোনওটার পাঁচিল ভেঙে পড়েছে, কোনওটার দেওয়াল ধসে গিয়েছে। এর আগে বহু বার প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে সাহায্য পেয়েছে আমজনতা। কিন্তু শুক্রবার ঘণ্টায় প্রায় ২২০ কি‌লোমিটার বেগে ঝড় প্রশাসনের উপরে সেই আস্থাটাকেই টলিয়ে দিয়েছে।

যে ভাবে টলিয়ে দিয়েছে সমুদ্র-শহরটাকে!

Cyclone Fani ফণী Water Agitation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy