Advertisement
E-Paper

টাটার দিকে আঙুল তুলে চিঠি মিস্ত্রির

প্রত্যাঘাত। টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরতে বাধ্য হওয়ার পরে প্রথমে মুখ খোলেননি। কিন্তু ‘নীরবতা ভেঙে’ এ বার টাটাদের দিকে সরাসরি অভিযোগের আঙুল তুললেন সাইরাস মিস্ত্রি।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:২১
টাটা সন্সের সদর দফতর বম্বে হাউস থেকে বেরোচ্ছেন সাইরাস।ছবি: পিটিআই।

টাটা সন্সের সদর দফতর বম্বে হাউস থেকে বেরোচ্ছেন সাইরাস।ছবি: পিটিআই।

প্রত্যাঘাত।

টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরতে বাধ্য হওয়ার পরে প্রথমে মুখ খোলেননি। কিন্তু ‘নীরবতা ভেঙে’ এ বার টাটাদের দিকে সরাসরি অভিযোগের আঙুল তুললেন সাইরাস মিস্ত্রি। ই-মেল পাঠালেন টাটা সন্সের পরিচালন পর্ষদের সদস্যদের।

ওই চিঠিতে পূর্বসূরি তথা অন্তর্বর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে ফিরে আসা রতন টাটাকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন সাইরাস। অভিযোগ, তাঁকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেননি টাটা। ছড়ি ঘুরিয়েছেন প্রায়ই। পঙ্গু করে রাখতে চেয়েছেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে। তিনি লিখেছেন, ‘‘আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না-দিয়ে যে ভাবে চেয়ারম্যানকে সরানো হল, তাতে বোর্ডের গৌরব বাড়েনি। কর্পোরেটের ইতিহাসে এমন ঘটেনি কখনও।’’ তাঁর মতে, বোর্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই পদ্ধতি বেআইনি।

মিস্ত্রির অভিযোগ, টাটা গোষ্ঠীতে নিজের ২১ বছরের রাজ্যপাটে এমন অনেক সিদ্ধান্ত টাটা নিয়েছেন, যাতে রিটার্ন ভাল মেলেনি, কিন্তু ঋণ বেড়েছে বহু গুণ। কিছু ব্যবসা এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে যে, হিসেবের খাতা থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ মুছে দেওয়ার মুখে টাটা গোষ্ঠী! তাঁর ইঙ্গিত, লাভের সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও ন্যানো গাড়ি তৈরি চালিয়ে যাওয়ার মতো বেশ কিছু সিদ্ধান্ত যত না ব্যবসায়িক, তার থেকে অনেক বেশি টাটার ব্যক্তিগত পছন্দ ও আবেগের জায়গা থেকে নেওয়া। সাইরাসের দাবি, প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েও টাটা-সাম্রাজ্যের এই ছবি বদলাতে চেয়েছিলেন তিনি।

এই চিঠির কোনও প্রতিক্রিয়া টাটারা দেয়নি। তবে তাদের ওয়েবসাইটে ফিরিয়ে আনা হয়েছে চেয়ারম্যান থাকাকালীন সাইরাসের দেওয়া সাক্ষাৎকার। তাঁর বিদায়ের পরেই যেগুলি সরিয়ে দেওয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছিল টাটা গোষ্ঠীকে। হয়তো কাকতালীয়, কিন্তু ওই সাক্ষাৎকারগুলির একটির বিষয় ছিল— পূর্বসূরির কাছ থেকে পাওয়া শক্ত ভিতের উপর ভর করে কী ভাবে আগামী দেড়শো বছরের জন্য গোষ্ঠীকে তৈরি করতে চান তিনি।

মিস্ত্রির বিদায়ের পর থেকেই কর্পোরেট দুনিয়া বলছিল, সংস্থা পরিচালনার কৌশল ও দর্শন— টাটাদের সঙ্গে এই দু’টি না মেলায় সরতে হয়েছে তাঁকে। সাইরাসের এ দিনের চিঠিতেও সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। সঙ্গে টাটার প্রতি ঝাঁঝালো আক্রমণ।

• আমাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, কোনও কাজে হস্তক্ষেপ করা হবে না।... কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পরেই সংস্থার বিধি পাল্টে ফেলা হয়।

• একবার টাটা সন্সের বোর্ড মিটিং চলাকালীন দুই মনোনীত ডিরেক্টর মিস্টার টাটার নির্দেশ আনার জন্য উঠে যান। অন্য ডিরেক্টরদের প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।

• যে হেতু ন্যানোকে লাভজনক করে তোলার কোনও পথই দেখা যাচ্ছে না, তাই ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে একটাই কৌশল হতে পারে— তা বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু আবেগের কারণে সেটা করা যায়নি।

সাইরাস মিস্ত্রি

তাঁর ই-মেল অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান হোটেলস, টাটা মোটরসের যাত্রীগাড়ি, টাটা স্টিলের ইউরোপীয় শাখা, টাটা পাওয়ারের একাংশ ও টাটা টেলি— এই পাঁচ ব্যবসাকেই খুব খারাপ অবস্থায় হাতে পেয়েছিলেন তিনি। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গিন যে, সেখানে ১ লক্ষ ৯৬ হাজার কোটি টাকা (গোষ্ঠীর নিট সম্পদের থেকে বেশি) ঢালার পরেও অবস্থা বদলায়নি।

আর এর প্রায় প্রতিটির পিছনেই রতন টাটার ভুল সিদ্ধান্তের উদাহরণ তুলে ধরেছেন সাইরাস। বৃষ্টিতে স্কুটারে সওয়ার কাকভেজা পরিবারকে দেখে একলাখি গাড়ি ন্যানো তৈরির কথা ভেবেছিলেন টাটা। অথচ গোড়া থেকেই তা তৈরির খরচ ছিল তার থেকে বেশি। সাইরাসের কথায়, ‘‘ন্যানোকে ঘুরিয়ে দাঁড় করানোর একটাই রাস্তা। তা তৈরি বন্ধ করা।’’ তাঁর অভিযোগ, কখনও লাভের সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও যে তা করা যায়নি, তার একটি কারণ ওই প্রকল্প নিয়ে টাটার আবেগ। আর একটি কারণ ওই গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির সংস্থায় তাঁর অংশীদারি!

গোষ্ঠীর উপর পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা চাপার জন্য টাটার এ রকম বহু সিদ্ধান্তের নমুনা তুলে ধরেছেন তিনি। যেমন, সস্তার ইন্দোনেশীয় কয়লার ভরসায় চড়া দামে মুন্দ্রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিনতে ঝাঁপিয়েছিল টাটারা। কিন্তু পরে নিয়ম বদলানোয় ২০১৩-’১৪ সালেই সেখানে লোকসানের অঙ্ক দাঁড়িয়েছিল ১,৫০০ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে তিনি তুলে এনেছেন টেলিকম ব্যবসায় জাপানি সংস্থা এনটিটি ডোকোমো-র সঙ্গে হাত মেলানোর শর্তে গলদ থাকার কথাও। তাঁর কথায়, ওই সংযুক্তি ভাঙতে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলার গুনতে হবে টাটাদের। সেই সঙ্গে ডোকোমোকে দিতে হবে ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এখন এ নিয়ে দু’পক্ষের ঝামেলা আদালতে গড়িয়েছে।

রতন টাটার জমানার শেষ এক দশকে ব্রিটিশ চা সংস্থা টেট্‌লি, দেয়ু-র বাণিজ্যিক গাড়ি, ইস্পাত বহুজাতিক কোরাস, ব্রিটিশ গাড়ি সংস্থা জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভারের মতো বহু বিদেশি সংস্থা কিনেছে টাটা গোষ্ঠী। সাইরাসের অভিযোগ, ‘‘টেট্‌লি, জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভার ছাড়া অন্যগুলি সফল হয়নি।’’ ঋণ বেড়েছে। কিন্তু মুনাফা সে ভাবে আসেনি। ইন্ডিয়ান হোটেলসের কিছু হোটেল ও ওরিয়েন্ট হোটেলসের অংশীদারি বিক্রি করতে হয়েছে ক্ষতি করে। ব্রিটেন, কেনিয়ায় টাটা কেমিক্যালসের ব্যবসার যা হাল, সেখানেও শক্ত পদক্ষেপ জরুরি।

টাটা গোষ্ঠীর মূল সংস্থা টাটা সন্স। ‘টাটা’ ব্র্যান্ড নাম ও ট্রেডমার্কের মালিকও তারা। এই টাটা সন্সের প্রায় ১৮.৫% মালিকানা নির্মাণ সংস্থা শাপুরজি-পালোনজি গোষ্ঠীর হাতে। যার চেয়ারম্যান পালোনজি মিস্ত্রির ছেলে সাইরাস। মূলত টাটা পরিবারের সদস্যদের হাতে থাকা টাটা ট্রাস্টস-এর অংশীদারি ৬৬%। ২০১২ সালে কর্ণধার হিসেবে অবসর নেওয়ার পরেও পুরোদস্তুর সক্রিয় ভাবে যার দেখভাল করেছেন রতন টাটা। সাইরাসের অভিযোগ, টাটা ট্রাস্টসের মারফত ক্রমাগত তাঁর সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেছেন টাটা।

যেমন, বিমান পরিবহণ ব্যবসায় পা রাখতে রাজি ছিলেন না মিস্ত্রি। কিন্তু তা করতে হয়েছে ওই ব্যবসার প্রতি টাটার ব্যক্তিগত দুর্বলতার কারণে। মিস্ত্রির দাবি, কার্যত তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করেই এয়ার এশিয়ার সঙ্গে হাত মেলানোর বিষয়টি পাকা করে ফেলেন রতন টাটা। ঢেঁকি গেলার মতো করে মানতে হয়েছিল বিমান পরিষেবা সংস্থা বিস্তারা চালু করার জন্য সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রস্তাবও। এতে একে তো একই গোষ্ঠীকে দু’টি বিমান পরিষেবা সংস্থা চালাতে হচ্ছে। তার উপর বিষফোঁড়া এয়ার এশিয়ার সঙ্গে চুক্তির সময় ২২ কোটি টাকা বেআইনি লেনদেনের অভিযোগ ওঠা।

টাটাদের দীর্ঘ দিনের আইনি উপদেষ্টা হরিশ সালভে এবং টাটা গোষ্ঠীর নতুন চেয়ারম্যান খুঁজতে তৈরি কমিটির সদস্য কুমার ভট্টাচার্য মঙ্গলবার জানিয়েছিলেন, টাটাদের ঐতিহ্য ধাক্কা খাওয়ায় সরতে হয়েছে সাইরাসকে। তাঁদের দাবি, সাইরাসের জমানায় ব্রিটেনে ইস্পাত ব্যবসা বিক্রির সিদ্ধান্তের কারণে সেখানে ১৫ হাজার কর্মী কাজ হারানোর মুখে। এ ভাবে ব্যবসা সাধারণত টাটারা করে না। কুমারবাবুর কথায়, মানুষ হিসেবে সাইরাস খারাপ নন। কিন্তু টাটা গোষ্ঠীর মতো বিশাল ব্যবসা সামলানোর মতো দূরদৃষ্টি তাঁর নেই। ঠারেঠোরে একই কথা এ দিন বলেছেন টাটা ট্রাস্টসের কয়েক জন সদস্য।

চিঠিতে সাইরাস জানিয়েছেন, ২০১১ সালে রতন টাটা ও কুমার ভট্টাচার্যই কর্ণধারের দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন তাঁকে। সেই প্রস্তাব প্রথমে ফিরিয়ে দেন তিনি। পরে যখন কোনও যোগ্য লোক মেলেনি, তখন রাজি হন।

সাইরাসের দাবি, দায়িত্ব নেওয়ার সময় তাঁর শর্ত ছিল সিদ্ধান্ত নেওয়ায় স্বাধীনতা। কিন্তু রতন টাটা ও টাটা ট্রাস্টস কখনও তাঁকে তা দেয়নি বলে অভিযোগের তির ছুঁড়েছেন তিনি।

লড়াই বোর্ডরুমে শুরু হয়েছিল। কিন্তু কুরুক্ষেত্র এ বার তার বাইরেও।

Cyrus Mistry Ratan Tata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy