Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Delhi Violence

ভয়ে দিল্লির বাড়ির হাল দেখতে যেতে পারেননি গোয়ালপোখরের আজাদ

গোয়ালপোখরের ঠাকুরতোলা গ্রাম থেকে ছেলের দুশ্চিন্তায় আম্মি বার বার ফোন করছেন। আজাদ বলেন, ‘‘আম্মি বাড়ির কী হাল, জানতে চাইছে। আমি তো নিজেই জানি না, কী অবস্থা।

দিল্লিতে ত্রাণ শিবিরে সন্তানদের খাওয়াচ্ছেন মহম্মদ আজাদ। নিজস্ব চিত্র

দিল্লিতে ত্রাণ শিবিরে সন্তানদের খাওয়াচ্ছেন মহম্মদ আজাদ। নিজস্ব চিত্র

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২০ ০৪:৩৮
Share: Save:

হাঁটা-পথে বাড়ি দশ মিনিটও নয়। ছ’দিন আগে প্রাণ বাঁচাতে মহল্লা থেকে বৌ-ছেলে নিয়ে পালিয়ে সরকারি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন উত্তর দিনাজপুরের মহম্মদ আজাদ। বাড়ির কী হাল, প্রাণের ভয়ে এখনও দেখতে যেতে পারেননি। ‘‘কখন কে মেরে দেবে, কে বলতে পারে!’’

গোয়ালপোখরের ঠাকুরতোলা গ্রাম থেকে ছেলের দুশ্চিন্তায় আম্মি বার বার ফোন করছেন। আজাদ বলেন, ‘‘আম্মি বাড়ির কী হাল, জানতে চাইছে। আমি তো নিজেই জানি না, কী অবস্থা। হিন্দুদের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। তাই ঘরে আগুন লাগায়নি। কিন্তু ওখানেই দর্জির কারখানা ছিল। সব লুট করে নিয়েছে শুনেছি। কত লোকসান হয়েছে জানি না।’’ বলতে বলতেই যেন আতঙ্ক ঘিরে ধরে আজাদকে। ছোট ছেলেকে জল খাইয়ে কোলে তুলে নেন।

উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখর থেকে বছর পনেরো আগে রুটি-রুজির সন্ধানে দিল্লিতে এসেছিলেন আজাদ। আস্তানা জুটেছিল উত্তর-পূর্ব দিল্লির ঘোন্ডার পুরনো গড়হি মেন্ডু গ্রামে। গুজ্জর অধ্যুষিত গ্রাম। চল্লিশ-পঞ্চাশ ঘর মুসলিম। সবাই এখন
খজুরি খাসের শ্রীরাম কলোনিতে আশ্রয় নিয়েছেন। পুরসভার কমিউনিটি হলে শিবির। মেঝেতে তোশক-চাদর পেতে একতলায় পুরুষদের, দোতলায় মহিলাদের থাকার ব্যবস্থা। তিন বেলা সরকার, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে খাবার আসছে। মহকুমা অফিসের কর্তারা এসে কার কত ক্ষতি হয়েছে, তার খোঁজ করছেন। দিল্লি সরকার আপাতত ২৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দিচ্ছে। বাকি ক্ষতিপূরণ পরে।

আজাদ বলেন, ‘‘সন্ধ্যায় আজানের সময়ে গ্রামের মুবারক মসজিদে হামলা হল। সবাই বলল, পালাও, না-হলে জানে মেরে দেবে। আমি বৌ-ছেলেদের নিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে পালিয়ে আসি। আর যাইনি।’’ আজাদের মতোই গোয়ালপোখর থেকে আসা মহম্মদ আনিফের দোকান ও বাড়িতে লুটতরাজ হয়েছে। জুন মাসে বড় মেয়ে শেহনাজের বিয়ে। বাড়িতে দেড় লক্ষ টাকার গয়না, বিয়ে ও ব্যবসার জন্য লাখ খানেক নগদ ছিল। আনিফ বলেন, ‘‘সব লুট করে নিয়েছে। সব শেষ।’’

এই শিবিরেই মাথা গুঁজেছে আব্দুল সাত্তারের পরিবার। আব্দুল ও তাঁর ছেলেরা করোল বাগে আসবাবের দোকানে কাজ করেন। ছোট মেয়ে আলিশার পরীক্ষা চলছে। আলিশার বৌদি আজরা বললেন, ‘‘মেয়েটার সব বই-খাতা পুড়ে ছাই। যেটুকু মনে আছে, লিখে আসছে। ওর মাধ্যমিকের মার্কশিট, সার্টিফিকেট পুড়ে গিয়েছে।’’

সোমবার সন্ধ্যায় গড়হি মেন্ডু-র মুবারক মসজিদের মুয়াজ্জিন মেহবুব হাসান আজানের প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন। তখনই মসজিদে পাথর ছোড়া শুরু। আট-দশ জন ঢুকে মেহবুবের মাথা ফাটিয়ে, পা ভেঙে দেয়। রাত থেকে বেছে বেছে হামলা চলে একের পর এক বাড়ি-দোকানে। আজরা বলেন, ‘‘গ্রামে আমরাই সব থেকে অবস্থাপন্ন ছিলাম। আমাদের বাড়িতেই প্রথম হামলা হয়। দু’মাস আগেই দুই দেওরের বিয়ে হয়েছে। দামি জিনিসপত্র, বাসন, গয়না বাড়িতেই ছিল। সব লুট করে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।’’

সোমবার রাত থেকে আজাদ-আনিফ-সাত্তারেরা পালিয়ে এলেও শুক্রবার পর্যন্ত গড়হি মেন্ডুতে হামলার কথা জানতেনই না সরকারি কর্তারা। পুরসভার হলঘরে দেড়শো-দু’শো মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন শুনে তাঁরা ওই গ্রামে যান। গিয়ে দেখেন অন্তত ১৫টি বাড়ি, ৫টি দোকান, বেশ কিছু গুদামঘর ও গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাত্তার বলেন, ‘‘গ্রামের গুজ্জররাই মুবারক মসজিদের জমি দিয়েছিল। বলেছিল, তোমরা থাকলে মসজিদ তো লাগবেই। রাজনীতির খেলায় বিষ ঢুকে সব ভাব-ভালবাসা শেষ করে দিল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Delhi Violence CAA Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE