Advertisement
E-Paper

বাড়িই শুধু পোড়েনি, বিশ্বাসও পুড়েছে আগুনে

ধরা গলায় মহম্মদ আব্বাস শুধু বললেন, ‘‘ভাড়া খাটিয়ে দু’পয়সা রোজগারের আশায় ডিলারের কাছ থেকে সবে কিনেছিলাম এই সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি। ”

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২০ ০৫:০৮
জতুগ্ৃহ: কিস্তিতে কেনা গাড়ি পুড়ে ছাই। ছুঁয়ে দেখছেন মহম্মদ আব্বাস। শিব বিহারে। নিজস্ব চিত্র

জতুগ্ৃহ: কিস্তিতে কেনা গাড়ি পুড়ে ছাই। ছুঁয়ে দেখছেন মহম্মদ আব্বাস। শিব বিহারে। নিজস্ব চিত্র

১১,৯২৭ টাকা।

সবে কেনা যে গাড়ির জন্য এই মাসিক কিস্তি, সামনে শুধু তার কঙ্কালটুকু দাঁড়িয়ে!

ধরা গলায় মহম্মদ আব্বাস শুধু বললেন, ‘‘ভাড়া খাটিয়ে দু’পয়সা রোজগারের আশায় ডিলারের কাছ থেকে সবে কিনেছিলাম এই সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি। কিস্তিও দিয়েছি মাত্র দু’টো। এখন ধার শোধ না-দিলে, ব্যাঙ্কের খাতায় আমি খেলাপি। অথচ যে গাড়িই আর নেই, তার জন্য বছরের পর বছর ঋণের কিস্তিই বা গুনব কী করে?’’

সংঘর্ষ বিধ্বস্ত শিব বিহারে আর্তনাদের মতো শোনায় আব্বাসের গলা। গাড়ির ভিতরে থাকায় তার সমস্ত কাগজও পুড়েছে বলে আরও অসহায় দেখায় তাঁকে। আর যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে, সেই গ্যারাজ যেন জতুগৃহ। সার দিয়ে দাঁড়ানো অন্তত ৬০-৭০টি গাড়ি পুড়ে শেষ। সিটের চিহ্ন নেই। স্টিয়ারিং শুধু বাঁকাচোরা গোল রড। দাঁত বার করে গিলতে আসছে ইঞ্জিন। আব্বাসের বন্ধু বলছিলেন, ‘‘বিয়ে-শাদি হলে এই গ্যারাজ ভাড়া দেওয়া হয়। নইলে এখানে নিশ্চিন্তে গাড়ি রাখেন মহল্লার সকলে। হিন্দু-মুসলিম সবাই।’’ গ্যারাজের মালিকও জানালেন, পুড়ে ছাই হওয়া বহু গাড়ির মালিকই হিন্দু। দু’ধর্মের লোকেরই গাড়ি জ্বালিয়ে তা হলে স্বার্থসিদ্ধি কোন জনের?

এই প্রশ্ন আর তাকে ঘিরে পারস্পরিক অবিশ্বাসের বীজই আজ দিনভর চোখে পড়ল শিব বিহার আর লাগোয়া মুস্তাফাবাদে।

অঙ্কিত পালের মিষ্টির দোকান পুড়ে ছাই, বাবু খানের আসবাবের শোরুম ধ্বংসস্তুপ। উত্তরাখণ্ড থেকে আসা দোকানের কর্মী দিলবরকে ক্ষতবিক্ষত করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বেই বাড়ি রাহুল সোলাঙ্কির। গলা ফুঁড়ে দেওয়া গুলি জীবন নিয়েছে যাঁর। অধিকাংশ জনই বলছেন, স্থানীয়রা নন, গোলমাল পাকিয়েছে বাইরের লোক। তবু পারস্পরিক দোষারোপের চোরা স্রোত বইছে।

শিব বিহারের সুমিত শর্মার প্রশ্ন, ‘‘আগে থেকে প্রস্তুতি না-থাকলে, কেন সে দিন সাড়ে ১২টার মধ্যে স্কুল থেকে বাচ্চাদের ছুটি করিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন মুসলিমরা? বেলা ১টার মধ্যে তাঁদের অধিকাংশের দোকানের ঝাঁপই বা পড়ে গেল কী ভাবে? কোন জাদুতে নিমেষে হাতে এল অস্ত্র, পাথর?’’ কিন্তু তা হলে এ তল্লাটেই এত মুসলিমের প্রাণ গেল কী ভাবে? কী করে ছাই হয়ে গেল তাঁদের অনেকের বাড়ি, দোকান? উত্তর নেই।

মুস্তাফাবাদের শরাফত আলির আবার অভিযোগ, ‘‘বাইরে থেকে চার বাসভর্তি লোক আসতে দেখেছি। মুখে জয় শ্রীরাম। তা না-হলে, দুই সম্প্রদায়ের মিলেমিশে থাকার জায়গায় বেছে-বেছে মুসলিমদের বাড়ি, দোকানকেই নিশানা করা হল কেন? কী করে এক মুসলিমের ছাই হওয়া আস্তানার পাশে অক্ষত থেকে যায় হিন্দুর বাড়ি?’’ কোনও হিন্দুর ছারখার হওয়া বাড়ির ছবি দেখালে, ‘অত জানি না’ বলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তিনিও।

দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা মুকেশ শর্মা বলছিলেন, ‘‘এখনও সন্ধ্যার পরে রাস্তার মোড়ে জনা কয়েক হিন্দুকে দেখলেই, রাস্তা বদলে ফেলছেন হিজাব পরা তরুণী। গলিতে কিছু ফেজটুপিকে এক সাথে দেখলে, থমকে যাচ্ছেন বাড়ির পথ ধরা হিন্দুও। এই ক্ষত সারাতে পারে শুধু সময়।’’

র‌্যাফ-সিআরপিএফ-পুলিশে ছয়লাপ এলাকায় নতুন করে হিংসার ঘটনা হয়তো ঘটেনি। কিন্তু সন্দেহের দেওয়াল ডিঙিয়ে এলাকার মন কবে কিছুটা স্বাভাবিক হবে, কেউ জানেন না।

দু’ধর্মের লোকেরই গাড়ি পোড়ানো দুষ্কৃতীরা এই দেওয়ালটাই তো চেয়েছিল!

Delhi Violence Shiv Bihar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy