সংসদ অচল হয়ে রইলেও পুরনো পাঁচশো-এক হাজার টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে নরেন্দ্র মোদী সরকার অনড়ই থাকছে। এখন মোদী সরকারের কৌশল হল, যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে, মানুষের ভোগান্তির অভিযোগ তুলে বিরোধীদের আক্রমণ ভোঁতা করে দেওয়া।
সরকার নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেও বিরোধী শিবির অবশ্য আরও এককাট্টা হয়েছে। সংসদের প্রথমদিনে রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়া, না-যাওয়া নিয়ে বিরোধী শিবিরে ফাটল ধরেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার করতে যাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়নি কংগ্রেস বা অন্য বিরোধী দলগুলি। কিন্তু সেই দূরত্ব কমিয়ে আজ কাছাকাছি এসেছে কংগ্রেস ও তৃণমূল।
আজ, শুক্রবার সংসদ অচল করে রাখার ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও তৃণমূলই প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। আগামী সপ্তাহে সংসদের রণকৌশল ঠিক করতে সোমবার কংগ্রেস নেতৃত্ব সব বিরোধী দলকে বৈঠকে ডেকেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, কংগ্রেসের ডাকা ওই বৈঠকে দলের তরফে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ দেবেন। তৃণমূল সূত্রের যুক্তি, অন্য কারও বদলে লোকসভার দলনেতা সুদীপকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকেই স্পষ্ট, দলনেত্রী বিরোধী ঐক্যকে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ও সিপিএমের জোটের পর থেকে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের যোগাযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লি-সফর এবং সংসদের গত তিন দিনের অধিবেশনে অনেক দিন পরে ফের সেই যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। মমতা যখন সব বিরোধী দল মিলে রাষ্ট্রপতির কাছে দরবারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন কংগ্রেস তাতে রাজি হয়নি। সূত্রের খবর, অহমেদ পটেল মমতাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতি ভবনে অভিযান না করে সবাই মিলে সংসদে যাওয়া হোক। শেষ পর্যন্ত তা না হলেও, শিবসেনা ও ন্যাশনাল কনফারেন্সকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলের রাষ্ট্রপতির কাছে দরবারের সমালোচনা করছে না কংগ্রেস। অহমেদ পটেল ছাড়াও দিগ্বিজয় সিংহ বা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মতো রাহুল গাঁধীর ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গেও গত কয়েক দিনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে তৃণমূল নেতাদের যোগাযোগ হয়েছে। এখনও কংগ্রেসের নোট বাতিলের খবর ফাঁস করে দেওয়ার তদন্তে যৌথ সংসদীয় কমিটি বা জেপিসি-র দাবিতে অনড় থাকলেও তৃণমূল সেই দাবিকে সমর্থন করছে না। মমতা আজও বলেন, ‘‘এর আগে সাত বার জেপিসি হয়েছে। কোনও লাভ হয়নি। জেপিসি রিপোর্ট ঠাণ্ডা ঘরে চলে যায়।’’
মমতার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছে না যাওয়ার পিছনে সিপিএমের মতো কংগ্রেসেরও যুক্তি ছিল, রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার শেষ অস্ত্র হতে পারে। তার আগে সংসদেই সরকারকে চেপে ধরা দরকার। কিন্তু অধিবেশনের প্রথম দিন, বুধবারই নোট বাতিল নিয়ে আলোচনায় সরকার রাজি হয়ে যায়। গোটা দিন আলোচনাও হয়। এর পরেই বিরোধী শিবির বুঝতে পারে, এতে কিছুই লাভ হচ্ছে না। তাই বৃহস্পতিবার থেকে কংগ্রেস, তৃণমূল মিলে দাবি তোলে, প্রধানমন্ত্রীকে আলোচনায় হাজির থাকতে হবে। বিতর্কে তাঁকে জবাবও দিতে হবে। এই একই দাবিতে আজও অনড় থেকেছে বিরোধীরা।
কংগ্রেসের কাছে তৃণমূলের পরামর্শ হল, সোমবার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, এ কে অ্যান্টনি বা কর্ণ সিংহের মতো প্রবীণ নেতারা রাজ্যসভায় বিতর্কের সময় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির দাবি জানাক। কংগ্রেসও এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে। লোকসভায় আলোচনা হলেও রাহুল গাঁধী নিজে বলবেন। উল্টো দিকে সরকার মনে করছে, দেরিতে আলোচনা হলেও সমস্যা নেই। কারণ পরিস্থিতি ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হলে, মানুষের ভোগান্তি নিয়ে বিরোধীদের আক্রমণের ঝাঁঝ থাকবে না। বিরোধীদের আক্রমণ আরও ভোঁতা করতে প্রধানমন্ত্রী নিজেও সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে পারেন বলে সরকারি সূত্রের খবর।
আজ লোকসভায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে ফের মুলতুবি প্রস্তাব এনেছেন। তাঁদের দাবি, অন্য সব কাজ মুলতুবি রেখে নোট বাতিল নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কংগ্রেস তাতে গলা মিলিয়ে বলেছে, হাজির থাকতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। স্পিকার সুমিত্রা মহাজন মুলতুবি প্রস্তাব না মানায় দুই দলের সাংসদেরা ওয়েলে নেমে এসে সংসদ অচল করে রেখেছেন। অধিবেশন শুরুর আগে গাঁধী মূর্তির সামনে খালি স্টিলের থালা, হাঁড়ি নিয়ে বিক্ষোভ দেখান তৃণমূল সাংসদরা। স্লোগান তোলেন, মানুষ কী খাবে, এটিএম কার্ড!
রাজ্যসভাতেও বিরোধী দলের দাবি ছিল, প্রধানমন্ত্রী হাজির হলেই আলোচনা ফের শুরু হবে। গতকাল উরিতে সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিহতের সংখ্যার সঙ্গে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর তুলনা টেনেছিলেন কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ। কংগ্রেসকে পাল্টা চাপে ফেলতে আজ বিজেপি সংসদে তাঁর ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করেছে। কংগ্রেস উল্টে দাবি তুলেছে, নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমা চাইতে হবে। সংসদের বাইরে মানুষের হেনস্থার অভিযোগ তুলে যুব কংগ্রেস সংসদ অভিযান করেছে। মহিলা কংগ্রেস আবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অভিযান করেছে। উল্টো দিকে আজাদের মন্তব্যের প্রতিবাদে বিজেপি এআইসিসি দফতরে গিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর চেষ্টা করেছে।
এক দিকে যখন কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে দূরত্ব কমেছে, তেমনই সংসদের মধ্যে বিজেপি ও জয়ললিতার এডিএমকে-র মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও বাড়ছে। কখনও এডিএমকে-র কাবেরী জলবণ্টন সমস্যা, কখনও তামিল মৎস্যজীবীদের সমস্যা নিয়ে এডিএমকে-র আলোচনার দাবি মেনে নিয়ে মোড় ঘুরিয়ে দিতে চাইছে মোদী সরকার। গুলাম নবি আজাদ তাই এডিএমকে নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘‘আপনারা সরকারের ফাঁদে পা দেবেন না।’’
আরও পড়ুন- শাসক-বিরোধী তরজায় উত্তাল সংসদ, সোমবার পর্যন্ত মুলতুবি লোকসভা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy