জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।—ফাইল চিত্র।
যে দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর মন্ত্রিসভার বৈঠকে নোট স্থগিতের মতো এক চাঞ্চল্যকর সিদ্ধান্ত নেন, সে দিন তিনি এতটাই সজাগ ছিলেন যে মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে জানিয়ে দেন, কেউই আজ এই বৈঠকে তাঁদের মোবাইল ফোন নিয়ে আসতে পারবেন না। বৈঠক চলার সময় কেউই তা ছেড়ে হুট করে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারবেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা তখনও বুঝতে পারেননি এমন একটা সাঙ্ঘাতিক সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নিজেই জানাবেন এবং ক্যাবিনেট তাতে সম্মতি জানাবে। বৈঠকের পর মোদী প্রসার ভারতীর মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে জানালেন এ কথা। আবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে ‘মিত্রোঁ’ বলে জাতির উদ্দেশে এই বক্তৃতা দিতে যাওয়ার আগে সতীর্থদের হাসতে হাসতে জানিয়ে দিয়ে যান, তাঁর ঘোষণার আগে এই সিদ্ধান্ত যেন কেউ কোথাও, বিশেষত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করে না ফেলেন।
এত গোপনীয়তা! এত সুরক্ষা, কিন্তু কেন? এই নোট স্থগিতের সিদ্ধান্ত কিন্তু গোটা দেশের রাজনীতিতে এমন এক প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল যা নিয়ে গত এক বছর ধরে আলাপ-আলোচনা চলছে তো চলছেই। চলছে তো চলছেই। আলোচনা-বিতর্ক আজও থামেনি। এ কথা মানতেই হবে, নোট স্থগিতের সিদ্ধান্তের পরেও উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলাফলে বিজেপি আরও বিপুল ভাবে জয়লাভ করায় গোটা দেশে নোট স্থগিতের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কণ্ঠস্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায়।
নোট স্থগিতের সিদ্ধান্তে মোদী এ দেশের আপামর মানুষের সামনে নিজেকে গরিবগুর্বো মানুষের বন্ধু বলে ‘প্রজেক্ট’ করতে সমর্থ হয়েছেন। ইন্দিরা গাঁধী ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পর ১৯৬৯ সালে নতুন স্লোগান তুলেছিলেন, ‘গরিবি হঠাও’। আর নরেন্দ্র মোদী আরও এক ধাপ এগিয়ে ঘোষণা করলেন, যেন তিনি এ দেশের প্রথম ধনী-বিরোধী প্রধানমন্ত্রী। নোট স্থগিতের মাধ্যমে তিনি যেন ধনী-কালোবাজারিদের উপর এক চূড়ান্ত কুঠারাঘাত করেছেন। এটাই ছিল বার্তা। যেমন নেহরু এক বার বলেছিলেন, ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে কালোবাজারি মজুতদারদের পেটানো প্রয়োজন। মোদী আরও এগিয়ে গেলেন।
পাশ্চাত্য দুনিয়ার সংবাদমাধ্যম এখন বলছে, ট্রাম্পের মতো মোদীও এক জন পপুলিস্ট নেতা। পপুলিস্ট নেতা মানেই আগে আমাদের প্রচলিত ধারণা ছিল যে তিনি বামপন্থী হবেন। এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি ডানপন্থী পপুলিস্টও হতে পারেন।
সমস্যা হচ্ছে অন্যত্র। এই নোটস্থগিতের সিদ্ধান্ত ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য কি ভাল হল? প্রথমত, এত কাণ্ডের পরেও দেশের আর্থিক হারের উন্নতি তো দূরের কথা তা শ্লথ হল। দ্বিতীয়ত, উৎপাদন মার খেল। তৃতীয়ত, সোনা ব্যবসায়ী এবং ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা মার খেলেন। এর ফলে বাইরের দেশ থেকে এ দেশে আমদানি আরও বেড়ে গেছে। অর্থাৎ এ দেশে চাহিদা যে কমে গেছে তা নয়। কিন্তু আমদানি বেড়েছে। এর ফলে রফতানিও বাড়ছে না, হয়তো আগের থেকে কিঞ্চিৎ উন্নতি হয়েছে। বিদেশি যদিও স্থিতাবস্থায়, সে ক্ষেত্রে সমস্যা আপাতত কম। তবু এটাও স্পষ্ট যে, এত কাণ্ড করেও এখন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে বিপুল অর্থের স্টিমুলাস দিতে হচ্ছে।
আমি অর্থনীতিবিদ নই। ভবতোষ দত্ত এক বার বলেছিলেন, দু’জন অর্থনীতিবিদ কখনও একমত হয়েছেন এমনটা দেখা যায় না। যত অর্থনীতিবিদ তত রকমের তত্ত্ব। কিন্তু আমজনতা, যাদের জন্য মোদী চোখের জল ফেলছেন, সত্যি সত্যিই তাদের কী উপকার সাধিত হল, এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy