কেন বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমান কেনা হবে?
আমদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার যে ড্রিমলাইনার বিমান ভেঙে পড়েছে, তা কেনার সময়েই যোজনা কমিশন এই প্রশ্ন তুলেছিল। সে সময়ে এয়ার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থা। কিন্তু যোজনা কমিশনের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ‘ড্রিমলাইনার’ কেনার সিদ্ধান্ত নেয় বিমান মন্ত্রক।
যোজনা কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্তারা জানাচ্ছেন, অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের শেষ দিকে এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমান কেনার প্রস্তাব আসে। যোজনা কমিশনের কাছে সেই প্রস্তাব খতিয়ে দেখার জন্য পাঠানো হয়। কমিশনের বিশেষজ্ঞরা বাকি সব কাজ ছেড়ে এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাঁদের তরফে মূলত দু’টি বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়েছিল। একটি প্রযুক্তিগত। দুই, আর্থিক প্রশ্ন। প্রযুক্তিগত প্রশ্নের মধ্যে ড্রিমলাইনের কাঠামোর বহর, বিমানের দৈর্ঘ্য ও তার ডানার দৈর্ঘ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। আর্থিক প্রশ্নের মধ্যে ছিল, এয়ার ইন্ডিয়ার মতো লোকসানে চলা সরকারি সংস্থার জন্য বিপুল দাম দিয়ে ড্রিমলাইনার কেনার কী প্রয়োজন!
কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্তাদের বক্তব্য, প্রাথমিক ভাবে বিমান মন্ত্রক ১১টি ড্রিমলাইনার কেনার প্রস্তাব পেশ করেছিল। কিন্তু কমিশনের আপত্তি নিয়ে বিমান মন্ত্রকের কর্তারা সদুত্তর দিতে পারেননি। অর্থ মন্ত্রকের নেতৃত্বে ‘এক্সপেন্ডিচার ফিনান্স কমিটি’-র বৈঠকে বলা হয়, কমিশনের আপত্তির বিষয়গুলি বিমান মন্ত্রক, এয়ার ইন্ডিয়া খতিয়ে দেখবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার আর্থিক বিষয়ক কমিটি ড্রিমলাইনার কেনার সিদ্ধান্তে অনুমোদন দেয়। ২০০৫-এ ২৭টি ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার কেনার জন্য বোয়িং সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়। তত দিনে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় এসে গিয়েছে। এরই একটি বিমান বৃহস্পতিবার আমদাবাদে ভেঙে পড়েছে।
মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে যোজনা কমিশন তুলে দিয়ে নীতি আয়োগ তৈরি হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স মিশিয়ে এয়ার ইন্ডিয়া সংস্থা আগেই তৈরি হয়েছিল। মোদী জমানায় তার বেসরকারিকরণ করে টাটা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ড্রিমলাইনার বিমানে প্রযুক্তিগত সমস্যা নিয়ে মোদী জমানায় বিমান মন্ত্রককে সংসদে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল।
২০১৬-য় বিমান মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী জয়ন্ত সিন্হা সংসদে জানান, এয়ার ইন্ডিয়ায় ড্রিমলাইনার আসার পরেই তাতে প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে বিমানের ‘সিস্টেম ডিজ়াইন’, অতিরিক্ত ‘ইন-বিল্ট সিস্টেম’-এর জন্য বিমানের সুরক্ষা নিয়ে সমস্যা হবে না। বিমানের সুরক্ষা ব্যবস্থার নিয়মিত উন্নয়নও হচ্ছে। বিমানের সফটওয়্যার, ইঞ্জিন ও অন্য কিছু যন্ত্রাংশেরসমস্যা দেখা দিয়েছে। বোয়িং সংস্থা ও জেনারেল ইলেকট্রিক-এর সঙ্গে আলোচনা করে সেই সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে।
২০১৩-এর জানুয়ারিতে আমেরিকার এফএএ (ফেডেরাল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)-এর নির্দেশে ডিজিসিএ সমস্ত বোয়িং ৭৮৭ বিমান বসিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ, জাপানে এই বিমানে কিছু সমস্যা দেখা গিয়েছিল। প্রয়োজনীয় মেরামতির পরে মে মাসে ফের ড্রিমলাইনারকে ওড়ার সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়। তার জন্য বোয়িং সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়াকে ক্ষতিপূরণও দিয়েছিল। ২০১৭-তেও সংসদে এ নিয়ে প্রশ্নে একই উত্তর দিয়েছিল বিমান মন্ত্রক। সেই সঙ্গে জানিয়েছিল, ২০১২-তে বোয়িং সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়াকে ড্রিমলাইনার জোগান দিতে শুরু করে। ২০১৭-র অক্টোবরে শেষ ড্রিমলাইনার এয়ার ইন্ডিয়ায় যোগ দেয়।
ড্রিমলাইনার কেনার জন্য বিপুল টাকা খরচ নিয়ে সিএজি-ও প্রশ্ন তুলেছিল। বিমান মন্ত্রক সূত্রের খবর, ২০১১-তে ২৭টি ড্রিমলাইনের বরাত কমিয়ে ১৪টি করে দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়া বোর্ড ২৭টি বিমান কেনার সিদ্ধান্তেই অটল থাকে। সে সময় এক-একটি ড্রিমলাইনার বিমানের দাম ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি ডলার।
বিমান মন্ত্রক কর্তাদের বক্তব্য, এখন টাটা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন এয়ার ইন্ডিয়ার ১৯৮টি বিমানের মধ্যে ৩৪টি ড্রিমলাইনার বিমান রয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি ৭৮৭-৮ মডেলের। বাকিগুলি ৭৮৭-৯ মডেল। একটি ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার ভেঙে পড়ার পরে বাকি ২৬টি বিমান নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়া কী করবে, তা দেখার বিষয়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)