আমেরিকার শুল্ক এবং সে দেশের সঙ্গে অসমাপ্ত বাণিজ্য চুক্তির চাপ কি কিছুটা নিষ্প্রভ করে দিল ভারত-রাশিয়া শীর্ষ বৈঠকের পর হওয়া চুক্তির মানকে? ভ্লাদিমির পুতিনের সফর শেষের পরে এই প্রশ্ন উঠছে নয়াদিল্লির কূটনৈতিক করিডরে।
অথচ আলিঙ্গন, প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করে এক গাড়িতে যাত্রা, নৈশভোজ— সবই হয়েছে নরেন্দ্র মোদী ও পুতিনের মধ্যে। কিন্তু হায়দরাবাদ হাউসে নরেন্দ্র মোদী এবং ভ্লাদিমির পুতিনের মহাবৈঠকের পরে হাতে যা পাওয়া গেল, তা একেবারেই সাদামাঠা বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। দুই রাষ্ট্রনেতার সামনে যে চুক্তিগুলি হল, তাতে কোনও শক্তির প্রদর্শন তো নেই-ই। বরং তা দু’দেশের সচিব-আমলা পর্যায়েই অনায়াসে সম্পন্ন করা যেতে পারত। চিন, আমেরিকা বা পশ্চিমি বিশ্বের উদ্দেশে যৌথ ভাবে ভারত-রাশিয়ার তরফ থেকে কোনও বার্তা দেওয়া হয়নি। ভারতের চিন সংক্রান্ত মাথাব্যথা নিয়েও রাশিয়া নীরব থেকেছে বলে সূত্রের খবর।
বিদেশ মন্ত্রকের একাংশের মতে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নির্ণীত হয় পারস্পরিক স্বার্থ এবং শক্তির সমীকরণের উপরে ভিত্তি করে। পারস্পরিক সম্পর্কের উপরে নয়। নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের একটা গুরুত্ব থাকে। কিন্তু সেটা স্বার্থের উপর ভিত-গড়া। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়নকেই বড় করে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে বলে মত সংশ্লিষ্ট মহলের। মনে করা হচ্ছে, একই ভুল করা হয়েছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও। এখন তার খেসারত দিতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ফলে কৌশলগত ক্ষতিপূরণ চোকাতে হচ্ছে মস্কোকে। সুইডেন, নরওয়ে-সহ পশ্চিমি জোট ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে ফিনল্যান্ড। পাশাপাশি, রাশিয়ার হামলায় পশ্চিমি দেশগুলি নিজেদের নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষার প্রশ্নে আরও কড়া হওয়ার কথা ভাবছে। সেখানে ট্রাম্পের প্রভাব বাড়ার এটাও একটা কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পুতিনের ভারত সফরে আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে দ্বিপাক্ষিক বার্তা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনও রকম প্রতিরক্ষা চুক্তির ধারেকাছে না হেঁটে দু’দেশের পোস্ট অফিসের মধ্যে সমন্বয়ের চুক্তিপত্র সই দুর্বলতারই চিহ্ন বহন করেছে। এটাও প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, দ্বিপাক্ষিক নীতির ক্ষেত্রে ভারত এবং রাশিয়া আগ্রাসী হতে পারছে না।
ট্রাম্প তাঁর বিচিত্র, পূর্বাভাসহীন কূটনীতির মাধ্যমে অন্তত এটা প্রমাণ করতে পেরেছেন যে, ভারতের হাতে বেশি উপায় নেই। মোদীকে পাশে রেখে পুতিন বাধাহীন ভাবে তেল সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু সেদিনই সন্ধ্যার সাংবাদিক সম্মেলনে বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী বুঝিয়ে গিয়েছেন, এটা কেবল কথার কথা। ট্রাম্পের শুল্কের প্রবল চাপে ভারত সস্তায় পাওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে তেল আমদানি একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। তার পরিবর্তে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন নতুন সামরিক চুক্তি নিয়ে বয়ান তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু আপাতত তা স্থগিত রাখা হয়েছে, সম্ভবত আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি ঝুলে থাকার কারণে। এস ৪০০ বা এস ৫০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়টি আলোচনার টেবিলে রয়েছে। কিন্তু সেগুলির ঘোষণা হলেও রাষ্ট্রীয় সফরের তুলনায় এমন কিছু মাইলফলক হত না। প্রতিরক্ষা সূত্রের খবর, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময়ে ব্যবহার করা ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র বেশি কার্যকর হয়েছে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ছোড়া রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রগুলির তুলনায়। তবু এই সামরিক সরঞ্জাম প্রযুক্তিগত ভাবে যথেষ্ট উন্নত বলে ভারতের সেনা তা কিনতে চাইছে।
কূটনৈতিক সূত্রের খবর, পুতিনের সঙ্গে মোদীর আলোচনায় চিন নিয়ে সাউথ ব্লকের শিরঃপীড়ার কথাও সে ভাবে জানানো সম্ভব হয়নি ভারতের পক্ষে। এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, চিনের কাঁটা নিয়ে রাশিয়া এই মুহূর্তের ভূকৌশলগত পরিস্থিতিতে ভারতের পাশে দাঁড়াবে না। বাষট্টিতেও চিনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তারা পাশে থাকেনি। আর এখন তো রাশিয়ার বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি! ইউরোপের সঙ্গে ধারাবাহিক সংঘাতে রাশিয়ার উপর চাপ বেশি পড়বে, কারণ ইউরোপের সম্মিলিত পুঁজি মস্কোর তুলনায় অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে চিনের উপর রাশিয়ার নির্ভরতা আরও বাড়বে বা ইতিমধ্যেই বাড়ছে। যা ভারতের জন্য সুখবর নয় বলেই মনে করা হচ্ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)