Advertisement
E-Paper

আংশিক সময়ের রাজনীতিককে পূর্ণ প্রত্যাখ্যান বিহারের, ভাষ্যে ও তত্ত্বে প্রাসঙ্গিক হয়েও ভোটের ময়দানে অপ্রাসঙ্গিক রাহুল গান্ধী

বিহারের রাজনৈতিক ভাষ্যে রাহুল যে অপ্রাসঙ্গিক ছিলেন, এমন নয়। বরং প্রাসঙ্গিক ছিলেন বলেই আরজেডি বা বামেরা কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে জোট গড়ার কথা ভাবেনি। ভোটের অন্তত বছর খানেক আগে থেকে রাহুলের বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাষ্য তথা তত্ত্ব বিহারে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছিল।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৫ ২১:১৪
Doctrines and narratives, floated by himself, are now destroyed by himself too, Bihar rejects part-time politician Rahul Gandhi in full force

রাহুল গান্ধী কি নিজের কর্মপদ্ধতি পুনর্বিবেচনার কথা আদৌ কখনও ভাববেন? প্রশ্ন তুলে দিল বিহারের ভোটের ফল। ছবি: পিটিআই।

দু’সপ্তাহে মোটা ১,৩০০ কিলোমিটারের রাজনৈতিক যাত্রা। সাসারাম থেকে শুরু করে ২০টি জেলা ঘুরে পটনা। সেখানে গান্ধী ময়দানে জনসভা করে ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’র সমাপ্তি। কিন্তু সেই সমাপ্তি যে পরবর্তী দু’মাসের জন্য বিহারে রাহুল গান্ধীর সব রকমের কর্মসূচিরও সমাপ্তি, তা সম্ভবত সে রাজ্যে কংগ্রেসের বড় শরিক রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) আঁচ করেনি। ছুটি কাটিয়ে, দক্ষিণ আমেরিকা সফর সেরে, ‘ভোটচুরি’র অভিযোগ সংক্রান্ত ‘হাইড্রোজেন বোমা’ ফাটিয়ে রাহুল বিহারে ফিরেছিলেন প্রচারের পড়ন্ত বেলায়। ফলাফল বলছে, বিজেপি তথা এনডিএ-র বিরুদ্ধে যতগুলি তত্ত্ব ভোটের আগে খাড়া করেছিলেন রাহুল, তার প্রতিটিই বিহারে শোচনীয় ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

বিহারের ইতিহাসে এ বারই কংগ্রেসের ফল সবচেয়ে খারাপ। শুধু নিজেদের খারাপ ফল নয়, শরিকদলের ভরাডুবির দায়ও কংগ্রেসের ঘাড়েই চাপছে। কারণ, ১৯৯৭ সালে লালুপ্রসাদ যাদবের হাতে জন্ম নেওয়া দল গত ২৮ বছরের সবচেয়ে খারাপ ফলও এ বারেই করল। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, লালু-পুত্র তেজস্বী একা নন, আরজেডি-র এই ফলাফলের জন্য দায়ী সনিয়া-তনয় রাহুলের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ও।

বিহারের রাজনৈতিক ভাষ্যে রাহুল যে অপ্রাসঙ্গিক ছিলেন, এমন নয়। বরং প্রাসঙ্গিক ছিলেন বলেই আরজেডি বা বামেরা কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে জোট গড়ার কথা ভাবেনি। ভোটের অন্তত বছর খানেক আগে থেকে রাহুলের বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাষ্য তথা তত্ত্ব বিহারে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছিল। কিন্তু দলগত ভাবে বিজেপি বা ব্যক্তিগত ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি কারও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হন, তা হলে সাফল্যের জন্য যে সর্বাগ্রে ২৪ ঘণ্টার রাজনীতিক হয়ে ওটা জরুরি, সে কথা রাহুল সম্ভবত বোঝেন না। অতএব ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ থেকে নিখোঁজ হয়ে যান মাঝেমধ্যেই। কষ্টার্জিত ‘জমি’ ফের হাতছাড়া হয়ে যায়।

গত ১৭ অগস্ট থেকে বিহারে ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ শুরু করেছিলেন রাহুল। শুরুর দিন উপচে-পড়া ভিড়। পদযাত্রা, জনসভা, বৈঠকি আলাপচারিতা চালাতে চালাতে এগোচ্ছিলেন রাহুল। এসআইআরের বিরোধিতা এবং ভোটে কারচুপি সংক্রান্ত অভিযোগ— দুই বিষয়কেই সফল ভাবে নিজের যাত্রায় জুড়ে নিয়েছিলেন। ভিড় দেখে আশা জেগেছিল গোটা ‘ইন্ডিয়া’ শিবিরেই। কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে কয়েক দিন পর থেকেই যাত্রা ঈষৎ ছন্নছাড়া হয়ে যায়। রাহুলকে অক্সিজেন জোগাতে যাত্রায় শামিল হন তেজস্বী। ফের কয়েকদিন ভিড় বাড়ে। কিন্তু এই ধরনের কর্মসূচিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা তৈরি করে মাঠে না নামলে যে পরিস্থিতি হওয়ার কথা, তা থেকে পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারেননি তেজস্বীও।

এ সবের অনেকটা আগেও অবশ্য রাহুল বিহারের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন জাতগণনার দাবি তুলে। তাঁর দাবি ছিল, জাতভিত্তিক জনগণনা করতে হবে। জনসংখ্যায় জাতপাতের অনুপাত অনুযায়ী শিক্ষা-চাকরি ইত্যাদিতে অধিকার নির্ধারিত হতে হবে। বাস্তবসম্মত হোক বা না হোক, রাহুলের কথাবার্তা সাড়া ফেলেছিল বিহারে। জাতপাতের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি ডুবে থাকা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ঝুঁকি না নিয়ে জাতগণনা করিয়েও ফেলেছিলেন। আরজেডি অভিযোগ করেছিল, বিহারে জাতভিত্তিক জনবিন্যাসের সঠিক সংখ্যা নীতীশের সরকার প্রকাশ করেনি। ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাহুলকে আর তা নিয়ে নুতন করে মাঠে নামানো যায়নি।

নিজের জোটসঙ্গীদের জন্য রাহুল আরও বড় সমস্যা তৈরি করেন আসন ভাগাভাগির সময়। আগের নির্বাচনে বিহারে ৭০টি আসনে লড়ে ১৯টি জিতেছিল রাহুলের দল। তাই আরজেডি এ বার কংগ্রেসকে অত আসন ছাড়ার পক্ষপাতী ছিল না। কিন্তু রাহুল প্রায় গোঁ ধরে বসেন। আরজেডি সূত্রের দাবি, ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’য় বিহারের বিভিন্ন অংশে ভিড় দেখে রাহুলের ধারণা হয়েছিল কংগ্রেসের পালে এ বার হাওয়া বেশি। তাই বেশি আসনের জেদ ধরে আসন সমঝোতা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৬১ আসনে প্রার্থী দেয় কংগ্রেস। বেশ কয়েকটি আসনে জোট শরিকদের বিরুদ্ধেই লড়তে নেমে পড়েন কংগ্রেস প্রার্থীরা।

এত কিছুর পরে রাহুল আবার উধাও হয়ে যান বিহারের ভোট ময়দান থেকে। সফরে যান ব্রাজ়িল, কলম্বিয়া, চিলে, পেরুতে। জোটসঙ্গী তেজস্বী প্রসাদ, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, মুকেশ সহানিরা যখন এনডিএ-র মোকাবিলা করতে গোটা বিহার চষে বেড়াচ্ছেন, তখন রাহুল দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিচ্ছেন বা পড়ুয়াদের সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নিচ্ছেন অথবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যখন নির্জোট আন্দোলনের যুগ, তখন এই সব দেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক ঐকমত্য ছিল। তাই সে সব দেশে রাহুলের সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে কংগ্রেস মুখপাত্ররা জানাচ্ছিলেন। কিন্তু পাশাপাশিই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাহুলের সেই ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে মোদী-নীতীশেরা বিহার রাজনীতির হাওয়া বদলানোয় মনোনিবেশ করেছিলেন।

মুখে মুখে প্রশ্ন ছড়াচ্ছিল, ভোটের প্রচার যখন তুঙ্গে, তখন টানা দু’মাস কেন বিহারে নেই রাহুল? কংগ্রেসকর্মীরা দিশাহীন ভাবে মাঠে-ময়দানে ঘুরছিলেন। দলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র পবন খেড়া বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, প্রতিদিন বিহারের মাঠে-ময়দানে নেমে রাহুলের প্রচার করার দরকার নেই। খেড়া বলেছিলেন, ‘‘কংগ্রেস ভিড়ের রাজনীতি করে না। বিষয়ভিত্তিক রাজনীতি করে।’’ সাধারণ জনতা দূরের কথা, খেড়ার সেই তত্ত্বে বিহারের কংগ্রেসকর্মীরাও সম্ভবত ভরসা রাখতে পারেননি। তবে বিহারে যে এখনও দিনের পর দিন মাঠে-ময়দানে থেকেই রাজনীতি করতে হয়, আংশিক সময়ের রাজনীতিক হলে যে চলে না, তা নিয়ে শুক্রবারের পরে কারওরই আর সংশয় থাকার কথা নয়।

Bihar Assembly Election 2025 Bihar Politics Rahul Gandhi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy