Advertisement
০৪ মে ২০২৪

পারলেই পালাচ্ছে মানুষ, ‘স্বচ্ছ ভারতে’ জল নেই

বৃষ্টি নেই। খরার কবলে দেশের ৪৫%। ঋণের দায়ে আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই কৃষকের। বাঁচার রাস্তা?বৃষ্টি নেই। খরার কবলে দেশের ৪৫%। ঋণের দায়ে আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই কৃষকের। বাঁচার রাস্তা?

যন্ত্রণা: তিন দিন পরে জল এসেছে গ্রামের কলে। নিজস্ব চিত্র

যন্ত্রণা: তিন দিন পরে জল এসেছে গ্রামের কলে। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস ঘড়াই
চন্নমপল্লি (অন্ধ্রপ্রদেশ) শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৯ ০৪:১১
Share: Save:

রাস্তার ধুলো উড়িয়ে জলের গাড়ি বেরিয়ে গেল এইমাত্র। জল ধরার তাড়াহুড়ো এদিনের মতো শেষ। বাড়ির এক চিলতে দাওয়ার উপরে খাটিয়া পাতা। সেই খাটিয়ায় বসেই রাস্তা আর ধুলোর বোঝাপড়া দেখছিলেন আর লক্ষ্মীনারায়ণ। কোনও কাজ নেই। বসে-বসে এসবই দেখেন। দূরে লাঙল-চলা শূন্য-খেত। খেতের ধারে একটা কাঁটাগাছ আষ্টেপৃষ্ঠে উঠেছে। লক্ষ্মীনারায়ণের মাঝেমাঝে ভয় হয়, পুরো খেতটাকেই না একদিন কাঁটাগাছটা গিলে ফেলে!

দাওয়ার পাশেই অনন্তম্মা জল ধরছিলেন। আর গজগজ করছিলেন, ‘‘শৌচালয় করে দিয়েছে! এদিকে জলই নেই!’’

কে শৌচালয় করে দিয়েছে? ‘‘কে আবার? সরকার! ওই স্বচ্ছ ভারত না কি আছে তাতেই তো ১৫ হাজার টাকা দিয়ে শৌচালয় বানিয়ে দিয়েছে।’’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন অনন্তম্মা। রোদ্দুরের তাপে ঝলসাচ্ছে চতুর্দিক, অনন্তম্মার মাথাও খুব গরম। অনেক বার বলার পরেও জলের গাড়ির লোকটা এদিন বেশি জল দেয়নি। অন্য দিন কাকুতি-মিনতি করলে বাড়তি বালতিতে জল দিয়ে দেয়। কিন্তু এ দিন না কি জলের টান রয়েছে। ‘‘সরকারই বা কী করবে? সরকারও তো বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছে মনে হয়। স্বচ্ছ ভারতের আর কী দোষ হল!’’ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বললেন লক্ষ্মীনারায়ণ।

এমনিতে অনন্তপুরে লক্ষ্মীনারায়ণদের চন্নমপল্লি গ্রামের সব বাড়িতেই স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের শৌচালয় আছে। কিন্তু জলই তো নেই। তাই ফিরে এসেছে পুরনো অভ্যাস। ছোট পাত্রে জল ভরে মাঠে-ঘাটে যাওয়া আর কী! গ্রামের বাসিন্দা এম রেড্ডি বলছিলেন, ‘‘গ্রামের ১২০টা ঘরেই গিয়ে দেখুন, স্বচ্ছ ভারতের শৌচালয় শুকনো, খটখট করছে।’’ জল নেই, তাই খরার দেশে চাষের জমির মতোই স্বচ্ছ ভারতের শৌচালয়েরও দাম নেই!

লক্ষ্মীনারায়ণদের বাড়িতে একটা ট্যাপ আছে বটে। কিন্তু গত দেড় বছর তাতে জল পড়ে না। অনন্তম্মা অবশ্য রোজ ট্যাপের দিকে নিষ্পলকে চেয়ে থাকেন। এই বুঝি জল এল! লক্ষ্মীনারায়ণ বলছিলেন, ‘‘প্রতিটা পরিবার এখন জল কিনে খায় এখানে। কিনতেই হয়। পাত্রপিছু ১০ বা পাঁচ টাকা।’’ অফুরান জলরাশির ‘অনুদান’ পেতে অভ্যস্ত শহুরে কেউই ভাবতে পারবেন না যে প্রত্যন্ত গ্রামে জল কিনে খেতে হয়, এমনকি, গ্রামের দরিদ্রতম পরিবারটিকেও! দৈনন্দিন জীবনে পানীয় জলের জন্য যে আলাদা বরাদ্দ রাখতে হবে, সেটা শিখিয়েছে খরা। একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০১৮-র জুন থেকে ২০১৯-র মার্চ পর্যন্ত গড়ে চার শতাংশ হারে কমেছে অনন্তপুরের ভূগর্ভস্থ জলস্তর।

তাই গ্রামের পর গ্রামে সপ্তাহ শুরু হয় গ্রামের মুখে বসানো ট্যাপের দিকে তাকিয়ে। সেই ট্যাপে তিনদিন অন্তর জল আসে। কবে জল এসেছিল, আর কবে জল আসবে, সেই গোনা দিয়ে সপ্তাহ শুরু হয়, সেই গোনাতেই সপ্তাহ শেষ! চন্নমপল্লির পাশের গ্রাম, বোম্মালতাপল্লির এল আম্মা বলছিলেন, ‘‘রবিবার জল আসার মানে মাঝে দু’দিন আর জল আসবে না। আবার বুধবার জল আসবে। ফলে সেদিন সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।’’ তোড়জোড় মানে বাড়িতে জল ধরার যত পাত্র রয়েছে, ছোট-মেজো সেই সব পাত্র জোগাড় করে কলের তলায় নিয়ে আসা। লাইন করে দাঁড়ানো। তারপর ঠায় তাকিয়ে থাকা, কখন জল আসবে! যে-দিন জল আসে, প্রতিটা গ্রামের মুখ রঙিন ছোট-বড় পাত্রে রঙিন হয়ে ওঠে যায়। গ্রামে যেন উৎসব। কিন্তু সে উৎসবের আয়ু আর কতটুকু! দায়লাকুন্তপল্লি গ্রামের রামাদেবী বলছিলেন, ‘‘নজরে রাখতে হয়, জল পড়ছে তো! বিশ্বাস নেই, কখন জল চলে যায়!’’

জল কখন চলে যায়!— এই ভয় সবসময় তাড়া করে বেড়ায় খরার এই ‘ভারত’-কে। যাঁরা পারছেন, কাজের খোঁজে অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছেন। বেসরকারি সংস্থার এক সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রায় সাত লক্ষ মানুষ কাজের খোঁজে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছেন। খরার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রকল্প ‘অন্ধ্রপ্রদেশ ড্রট মিটিগেশন প্রজেক্ট’-এর এক কর্তা বললেন, ‘‘দ্য মহাত্মা গাঁধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিমের মাধমে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করে ‘মাস মাইগ্রেশন’ আটকানোর চেষ্টা করছে সরকার। খরা-কবলিত এলাকার মানুষকে যাতে কাজের খোঁজে অন্যত্র না যেতে হয়, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।’’ কিন্তু চাষিদের দাবি, সব এলাকাতেই ওই প্রকল্পে কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। কাজ পেলেও মজুরি বাবদ টাকা হাতে পেতে দিন গড়িয়ে যাচ্ছে।

‘‘বৃষ্টি নেই, জল নেই, ফসল নেই, কাজ নেই। শুধু ভয় রয়েছে। এই বুঝি খারাপ কিছু হল, এই বুঝি এদিন আর জল এল না, এই বুঝি সরকারি জলের গাড়ি এল না! কী খাব, কী ভাবে সংসার চলবে!’’, উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ। সেই ভয়ের হাত থেকে বাঁচতে স্ত্রী-ছেলেমেয়ে-চাষের জমি ফেলে কাজের খোঁজে দূরে চলে যান লক্ষ্মীনারায়ণও। প্রথমে অনন্তপুর শহরে, অনন্তপুরে কাজ না পেলে বেঙ্গালুরুতে, বেঙ্গালুরুতে কাজ না পেলে অন্য কোথাও। আরও দূরে। যেখানে খরার হাত পৌঁছয় না সেখানে!

পিছনে পড়ে থাকে সরকারি জলের গাড়ি, গ্রামের মুখে বসানো অনিশ্চয়তার ট্যাপ আর স্বচ্ছ ভারতের শুকনো-খটখটে শৌচালয়। আর ট্যাপের বেরনো পাইপের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা অনন্তম্মা।—যদি কখনও সেটায় ফের জল আসে, এই আশায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Andhra Pradesh Drought
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE