Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বেতলা সঙ্গীহীন, বিদায় নিল আনারকলি

ওরা যে অন্যরকম, সবাই জানে। এই যেমন ওরা কোনও কথা ভোলে না। যাকে ভালবাসে, বড্ড বেশিই ভালবাসে। রাগলে অগ্নিশর্মা। আবার ওদের চোখেও জল আসে। তবু আরও অবাক করত আনারকলি। ধরা যাক, ওর পিঠে চড়ে আপনি বেরিয়েছেন জঙ্গলে।

চিরঘুমে আনারকলি। শুক্রবার বেতলায়। —নিজস্ব চিত্র

চিরঘুমে আনারকলি। শুক্রবার বেতলায়। —নিজস্ব চিত্র

আর্যভট্ট খান
রাঁচি শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৬ ০২:১৬
Share: Save:

ওরা যে অন্যরকম, সবাই জানে। এই যেমন ওরা কোনও কথা ভোলে না। যাকে ভালবাসে, বড্ড বেশিই ভালবাসে। রাগলে অগ্নিশর্মা। আবার ওদের চোখেও জল আসে। তবু আরও অবাক করত আনারকলি।

ধরা যাক, ওর পিঠে চড়ে আপনি বেরিয়েছেন জঙ্গলে। ছবি তুলতে তুলতে আপনার ক্যামেরাটা গেল ঝোপের মধ্যে পড়ে। আনারকলি ঝোপের মধ্যে থেকেই খুঁজে ঠিক বের করে আনবে ক্যামেরাটা। শুঁড়ে করে তুলে দেবে পিঠে বসা আপনার হাতে।

গল্পটা বলছিলেন বেতলার ট্যুর অপারেটর মহম্মদ আসলাম। বললেন, ‘‘ক্যামেরা তো বটেই, পকেট থেকে পড়ে যাওয়া মানিব্যাগ পর্যন্ত খুঁজে দিত ও। কত পর্যটক আছেন, যাঁরা এখানে এসে আনারকলিরই খোঁজ করতেন। বলতেন, ওঁদের বাবা-মায়েরা বেতলা বেড়াতে এসে আনারকলির পিঠে চেপে ঘুরেছিলেন। তাই ওঁরাও আনারকলির পিঠেই চড়বেন। ও ছিল বেতলার স্বজন। গত কাল সন্ধেয় সেই বেতলাতেই চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে ৭০ বছরের ‘ঠাকুমা’ হাতি আনারকলি। গোটা বেতলা ন্যাশনাল পার্কে নেমেছে শোকের ছায়া।

আত্মীয়-বিয়োগের শোকে কাতর আনারকলির দীর্ঘদিনের মাহুত ইমামুদ্দিন। খবরটা পেয়ে অনেকেরই মনে পড়েছে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আদরিণী’। অকালে মৃত এক মেয়ে হাতি আর তার বৃদ্ধ মনিবের গল্প। আনারকলির মৃত্যু অবশ্য মূলত বয়সজনিত কারণেই, বলছেন রাঁচির বিরসা জুলজিক্যাল পার্কের চিকিৎসক অজয় কুমার। আজ দুপুরে তার দেহের ময়না-তদন্ত হয়। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘‘পরশুই ওকে দেখতে আমি বেতলায় যাই। এক বছর ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিল। সেটা বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত ‘মাল্টি-অর্গান ফেলিওর’ হয়ে গেল।’’

বেতলা ন্যাশনাল পার্কের ডিএফও (কোর এরিয়া) অনিলকুমার মিশ্রের কথায়, ‘‘আনারকলির মৃত্যুতে শেষ হয়ে গেল বেতলার একটা অধ্যায়। এই জঙ্গলে আনারকলিকে নিয়ে কত গল্প যে লোকমুখে ছড়িয়ে আছে! আমজনতা থেকে ভিআইপি, ও ছিল সবার আপনজন।’’ এককালে অজস্র ছবির শ্যুটিং হয়েছে বেতলায়। জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে সেই আনারকলিরই খোঁজ করেছে গোটা ফিল্ম ইউনিট। দিলীপ কুমার, শর্মিলা ঠাকুর, রবি ঘোষ, উৎপল দত্ত, অনিল চট্টোপাধ্যায়, শত্রুঘ্ন সিন্হা, নানা পটেকর— কে নেই? নেতাদেরও প্রথম ও শেষ পছন্দ ছিল সেই আনারকলিই।

কেন এত জনপ্রিয় ছিল ও? ইমামুদ্দিনের মতে, পর্যটকদের ঘোরানোর সময়ে আনারকলি তাঁদের জঙ্গলের এমন এমন জায়গায় নিয়ে যেত, যেখানে জন্তু-জানোয়ারের দেখা মিলতই। আনারকলির পিঠে চেপে অনেকেই বেতলায় বাঘ দেখেছেন। ‘‘ও যেন ট্যুরিস্টদের মন বুঝতে পারত, জানেন। ওর পিঠে বসে কেউ ভয় পেলে নিজেই চলার গতি কমিয়ে দিত। ও অসুস্থ জেনেও এক রকম বাধ্য হয়েই ওকে কাজে নামাচ্ছিলাম। জঙ্গলে ঘোরানোর জন্য এখানে তো শুধু দু’টোই হাতি ছিল। আনারকলি আর জুহি। এখন তো আনারকলি চলে গেল।’’— বুড়ো মাহুত বলেন আর ভেঙেচুরে যেতে থাকেন।

গত কাল থেকেই জুহির চোখে জল। কিন্তু উপায় কী! সামনেই পর্যটনের মরসুম। একা জুহি পারবে ভিড়ের চাপ নিতে? ডিএফও বললেন, ‘‘সমস্যা তো হবেই। রাখি নামে আর একটা হাতি রয়েছে। কিন্তু সে ছোট। তাকে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে।’’ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতির জন্য কয়েক জায়গায় দরবার করেছেন ডিএফও। কিন্তু জানান, আনারকলির জায়গা পূরণ হবে না। ১৯৮১-তে এসেছিল বিহারের শোনপুর মেলা থেকে। আজ বেতলার মাটির গভীরে বিশ্রাম নিতে গেল আদরের আনারকলি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Elephant Anarkali Betla forest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE