E-Paper

নেপালি যুবাদের ‘রিল’ তৈরির ধাক্কায় হাতি লোকালয়ে

ভারত-নেপালের সীমান্ত এঁকে পড়ে থাকা মেচি নদী এখন নুুড়ি পাথর আর বালিয়াড়ির দখলে। নদীর কিনারায় কোমর জলের ধারা। বিকেলে সেখানেই বসে নেপালি যুবাদের ‘রিল উৎসব’!

রাহুল রায়

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৫ ০৮:৩৯
নেপালে মেচি নদীর তীরে হস্তিকুলের সামনে রিল বাহিনী।

নেপালে মেচি নদীর তীরে হস্তিকুলের সামনে রিল বাহিনী। ছবি: সমীরণ রাজ।

দুপুর বিকেলের দিকে গড়িয়ে গেলে নদীর চেহারাটা বদলে যেতে থাকে রোজ। সাদা বালিয়াড়ি ভেঙে নেমে আসা অজস্র মোটরবাইকের গর্জন, পিছনে সওয়ারির হাতে ‘সেলফি স্টিক’। উচ্ছ্বল ভ্লগারদের ‘রিল’ তৈরি হচ্ছে— ‘মা উনি রা হাতি’ (আমি সে ও হাতি)। তাদের হাস্যমুখ নিজস্বীর আড়ালে তত ক্ষণে ধরা পড়েছে এক দঙ্গল হাতি।

ভারত-নেপালের সীমান্ত এঁকে পড়ে থাকা মেচি নদী এখন নুুড়ি পাথর আর বালিয়াড়ির দখলে। নদীর কিনারায় কোমর জলের ধারা। বিকেলে সেখানেই বসে নেপালি যুবাদের ‘রিল উৎসব’! যার দাপটে উত্তরবঙ্গের হস্তিকুলের চলাচলের এই চেনা পথটি (এলিফ্যান্ট করিডর) প্রায় মুছে যেতে বসেছে। তার ফল ভুগছে কার্শিয়াং তথা উত্তরবঙ্গের একাধিক গ্রামের চা বাগানের হাজারো শ্রমিক আর গাঁ-গঞ্জের প্রায় ৩৭ হাজার বাসিন্দা। ফসলের ক্ষয়ক্ষতি তো আছেই, সঙ্গে রাতবিরেতে হাতি-হানার আতঙ্ক। যে হানায় গত দু’বছরের শিকার ২৪ জন গ্রামবাসী এবং ২ বনকর্মী। আহতের সংখ্যা অন্তত ৫৬।

পানিঘাটা বনাঞ্চলের রেঞ্জ অফিসার সমীরণ রাজের বক্তব্য, নিত্য এই উপদ্রবে হস্তিকুলের কাছে মেচি নদীর জলটুকুও ব্রাত্য হতে বসেছে। নদীর লাগোয়া নেপালের বাহনডাঙির জঙ্গলে নৈশাহারেও দাঁড়ি পড়ে গিয়েছে প্রায়। বনের হস্তিকুল তাই পথ বদলে কার্শিয়াং বনাঞ্চলের কলাবাড়ি, পানিঘাটা, দুরামারি কিংবা লোহাগড় চা বাগানের লাগোয়া কুলি লাইনে চালাচ্ছে সান্ধ্য-সংহার। হস্তি সংরক্ষণে দেশের সর্বোচ্চ সংস্থা ‘প্রোজেক্ট এলিফ্যান্ট’-এর রিপোর্ট বলছে, কলাবাড়ি এবং পানিঘাটায় হাতির হানায় প্রাণহানির সংখ্যা গত কয়েক বছরে তাই সর্বাধিক। দেশেরবনমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শরণাপন্ন হয়ে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনায় বসার আর্জিও জানিয়েছেন।

সমীরণ বলছেন, ‘‘স্থানীয় লোক জন হাতির পথ আটকে ভিডিয়ো করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হক রয়েছে আমাদের। কিন্তু নেপালের মানুষজনকে তো আর রুখতে পারি না। এই লাগামহীন উপদ্রবের পরিণতিতে আমাদের গ্রামগুলি প্রায় নিঃস্ব হতে বসেছে।’’ আন্তর্জাতিক সীমান্ত ঘেঁষা নদীর মাঝ বরাবর অধিকার থাকে দু’দেশের। সীমান্ত প্রহরায় থাকা এসএসবি’র (সীমা সুরক্ষা বল) এক কমান্ড অফিসারের কথায়, ‘‘আমাদের হাত-পা বাঁধা। ভিন্‌ দেশের মানুষ জনকে বাধা দেব কী করে!’’ নেপালের ঝাপা জেলার ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার মেঘরাজ রাই পাল্টা বলছেন, ‘‘হাতির পথ আটকে ভিডিয়ো না করার অনুরোধ জানিয়ে মাইকে প্রচার চলছে। কিন্তু কথা না শুনলেকী করব!’’

মানুষের এঁকে দেওয়া সীমান্তের রেয়াত করে না পশুপাখি। উত্তরবঙ্গের হস্তিযূথেরও নেপালে চলাচল ছিল এমনই অবিরাম। তবে সম্প্রতি সে ছবিতে রক্তের দাগ লেগেছে। সমীরণ বলেন, ‘‘কখনও গুলি কখনও বা ইলেকট্রিক তারে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে গত দু’বছরে অন্তত ১৩টি হাতিকে খুন করা হয়েছে নেপালে। দেশান্তরী হাতিদের সামলে রাখাও আমাদের দায়।’’

বন দফতরের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের এই হস্তি-সমস্যার সুরাহা খুঁজছে সর্বভারতীয় সংস্থা ‘নেচার এভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটি’ (নিউজ়)। ‘নিউজ়’-এর কর্ণধার বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘এ দেশীয় হাতিদের নেপাল অভিযান নতুন নয়। তবে, সে পথে এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নেপালের সশস্ত্র পুলিশ। মেচি পার হয়ে হাতিরা সে দেশে পা রাখলেই ছুটে আসছে গুলি। শ’দুয়েক হাতির অন্তত ৩টি দলকে জঙ্গলের ঘেরাটোপেই বেঁধে রাখা সম্ভব? বনে চেপ্টি, ঢাধকার মতো ঘাস বুনে তাদের পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। কিন্তু ওই ঘাস আর মুখে রুচছে না হাতিদের। আবার বনের লাগোয়া এলাকায় পা রাখলেই নেপালি তরুণদের উপদ্রব।’’ গাড়ি, ম্যানপ্যাক, লুকনো ক্যামেরা বসিয়ে হাতিদের গতিবিধি নজর রাখতে বন দফতরকে সাহায্য করে চলা সংস্থাটির এখন পাখির চোখ, লোকালয়ে যেন পা না রাখে হাতি।

অন্য একটি বন্যপ্রেমী সংগঠন ‘নেচার অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাসোসিয়েশন’ (এনডব্লুএ)-এর পক্ষে অনুজিত বসু বলছেন, ‘‘হাতিদের চলাচলে নজরদারি করতে অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। হাতির পাল লোকালয়ে ঢুকলে বা নেপালমুখী হলেই ‘ক্যুইক রেসপন্স টিম’ পাঠিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে জঙ্গলের গণ্ডিতে। স্থানীয় মানুষ জনকে সচেতন করে স্বল্প পারি‌শ্রমিকে হস্তি-বন্ধু দলও গড়া হয়েছে। কিন্তু নেপালে গিয়ে তো সচেতনতার পাঠ দিতে পারি না।’’ তা হলে?

মেচির বুকে সে উত্তরই মাথাকুটে মরছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Elephants Social Media Mobile Addiction India-Nepal

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy