Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
lata mangeshkar

Lata Mangeshkar Death: মৃত্যুই নশ্বর লতার কাছে

সারা ভারত যদি চোখ বুজে কোনও একটি গলাকে চিনতে পারে, সেটি লতার। 

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:৫৬
Share: Save:

মধুরের শেষ পাওয়া যায় না, তবু প্রহর শেষ হয়। বিদ্যাদায়িনী দেবীর নিরঞ্জনের দিনটি সুর-সরস্বতীর বিদায়-রাগিণীর সঙ্গে মিশে যায়।

সো যা রাজকুমারী...।

নব্বইয়ের দশকে তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি অ্যালবাম শুরুই হয়েছিল কে এল সায়গলের এই গানটি দিয়ে। মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ৯২ বছরের রাজকুমারী লতা মঙ্গেশকর শেষ বারের মতো ঘুমিয়ে পড়লেন আজ সকালে।

প্রায় এক মাসের লড়াই। মাঝে উন্নতি হয়েছিল অনেকটাই। কিন্তু শনিবার রাত থেকে ফের ভেন্টিলেশনে দিতে হয়। আশা ভোঁসলে হাসপাতালে ছুটে যান। সনিয়া গান্ধী উদ্বেগ জানিয়ে টুইট করেন। আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়েছিল তখনই। সকালে ৮টা ১২ মিনিটে তা সত্যে পরিণত হল। কোভিডের তৃতীয় ঢেউ ছিনিয়ে নিয়ে গেল লতাকে। কোভিডমুক্তি হলেও তার অভিঘাতকে হারানো গেল না।

আসমুদ্রহিমাচল যদিও বহু দশক ধরেই জানে, লতার মতো শিল্পীর জন্য মৃত্যুই নশ্বর। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটা দেশ যাঁর কণ্ঠ শুনতে শুনতে সহস্রাব্দ পার করে গিয়েছে, তিনি লতা মঙ্গেশকর। সারা ভারত যদি চোখ বুজে কোনও একটি গলাকে চিনতে পারে, সেটি লতার। মধুবালা থেকে মাধুরী দীক্ষিত— হিন্দি ছবি কত মোড়ই না পেরিয়েছে। গায়ে জড়ানো আঁচল আর আবাল্যসঙ্গী দু’টি লম্বা বিনুনি নিয়ে নিষ্কম্প থেকে গিয়েছে একটি গলা— লতা মঙ্গেশকর।

চল্লিশের দশক থেকে নয়া সহস্রাব্দের গোড়া— ভারতে যিনি যখনই জন্মে থাকুন, লতার গান শুনে বড় হয়েছেন এবং একই সঙ্গে লতার নতুন আর পুরনো গান শুনতে শুনতে

বেড়ে উঠেছেন। লতার সঙ্গে যাঁর প্রথম পরিচয় ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ বা ‘বরসাতমে হমসে মিলে’ দিয়ে, তিনি পরবর্তী আরও তিন-চার দশক আওয়ারা, আনারকলি, নাগিন, মুঘল-ই-আজম, গাইড হয়ে হয়তো সত্যম শিবম সুন্দরমে এসে তাঁর শ্রবণ-সফর শেষ করেছেন। যিনি ‘দিল দিওয়ানা বিন সাজনাকে’ বা ‘দিদি তেরা দেবর দিওয়ানা’ দিয়ে লতাকে প্রথম শুনলেন, তিনি ফিরে গিয়েছেন ওহ কৌন থি, বিশ সাল বাদ, মধুমতী, পাকিজ়া বা অভিমান-এর মূর্ছনায়।

লতা মানে কেবল একটি যুগের অবসান নয়, আট দশকের সঙ্গীতজীবনে তিনি একাই যে বহু যুগের সমাহার। ১৯৪২ সালে লতা যখন মরাঠি ছবির জন্য প্রথম গান রেকর্ড করছেন, দিলীপ কুমার তখনও ফিল্মে আসেননি। ২০১৩ সালে যখন সঞ্জয় লীলা ভন্সালী তাঁর ছবিতে লতার গান রাখছেন, তখন নায়ক হচ্ছেন রণবীর সিংহ। গুলাম হায়দার থেকে এ আর রহমান, লতার সুরকার। মহম্মদ রফি থেকে সোনু নিগম, তাঁর সহশিল্পী। নেহরু থেকে নরেন্দ্র মোদী, তাঁর গুণমুগ্ধ।

৩৬টি ভাষায় হাজারেরও বেশি ছবিতে গেয়েছেন লতা। আছে ভজন, গজ়ল-গীতের অ্যালবাম। বাংলাতেই তাঁর গানের সংখ্যা দুশোর কাছাকাছি। কম সময় ধরে বাঙালিই কি নিজের ভাষায় লতাকে শুনছে? ১৯৫৩-র ছবি ‘বৌঠাকুরানীর হাটে’ রবীন্দ্রসঙ্গীত। দু’বছর পরে নচিকেতা ঘোষের সুরে লতার গান বাংলা ছবি ‘অর্ধাঙ্গিনী’-তে। ১৯৫৬ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে আধুনিক গান ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’। বিশ্বজিতের প্রথম হিন্দি ছবির গান গেয়ে পুরস্কার জিতেছিলেন, নব্বই দশকের কলকাতা বিশ্বজিৎ-পুত্র প্রসেনজিতের ছবিতেও লতাকে গাইতে শুনল, ‘বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি!’

স্বাধীন ভারতে বস্তুত লতাই সর্ববৃহৎ তারকা— যাঁর কর্মজীবনের ব্যাপ্তি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, আধিপত্য একচ্ছত্র, শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদী। তাঁর কণ্ঠের মাধুর্য এতটাই নিখাদ, স্বরক্ষেপণ এতই নিখুঁত, একাগ্রতা এতই তীব্র যে, তাঁর প্রতিভাকে অতিলৌকিক বলে ভ্রম হয় পদে পদে। সেই কারণেই রাজনৈতিক অবস্থান বা পেশাগত কাঠিন্য, কিংবা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জল্পনা— কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত লতার ভাবমূর্তির মাপকাঠি হয়ে উঠতে পারেনি, পারে না। শুধু ‘বন্দেমাতরম’ বা ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোঁগো’ গেয়েছেন বলে নন, লতা ভারতের স্বর হয়ে উঠেছেন কারণ, তিনি কোণে কোণে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ঝুমরি তালাইয়াকে এক সুতোয় গেঁথে বলতে পেরেছেন, ‘মেরা সায়া সাথ হোগা!’

দক্ষিণ মুম্বইয়ের পেডার রোড দিয়ে গেলে যে কোনও অটোচালক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলে ওঠেন, ‘‘ওই যে লতাজির বাংলো!’’ আজ দুপুরে হাসপাতাল থেকে তাঁকে শেষ বারের মতো আনা হল সেই প্রভুকুঞ্জে। সেখানেই শ্রদ্ধা জানালেন অমিতাভ বচ্চন। এলেন শাহরুখ খান, বিদ্যা বালন। বিকেলবেলা যখন লতাকে আনা হচ্ছে শিবাজি পার্কে, ফুলে ঢাকা গাড়ির মাথায় তাঁর অতিপরিচিত হাসিমুখের ছবিটি জ্বলজ্বল করছে। যেন, শেষ বারের মতো নিজের শহরটিকে দেখে নিচ্ছেন তিনি। তাঁর জানা হয়নি, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় দু’দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করছে েদশ। এক ঘণ্টা মুলতুবি থাকবে কাল রাজ্যসভার অধিবেশনও।

শিবাজি পার্ক— লতার প্রিয় ক্রিকেটার সচিন তেণ্ডুলকরের শিক্ষাঙ্গন। সেখানেই সন্ধে সাড়ে ছ’টায় বৈদিক রীতি মেনে চন্দন চিতায় অন্ত্যেষ্টি। আদিত্য ঠাকরে, শরদ পওয়ার, রাজ ঠাকরে, পীযূষ গয়াল তত ক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সব রাজনৈতিক কর্মসূচি বাতিল করে চলে এসেছেন। আশা ভোঁসলে, শাহরুখ, সচিন, আমির খান, রণবীর কপূররা উপস্থিত। গান স্যালুটের অপেক্ষায় লতার দেহ তখনও জাতীয় পতাকায় মোড়া। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায়।

তবু বিদায়ই তো! যাবার বেলায় পিছু থেকে ডাক দিয়ে কেন বলো কাঁদালে আমায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

lata mangeshkar Legend Celebrity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE