Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Sholeh Wolpe

আমাদের শব্দচয়নেই যুদ্ধের ভাব, বলছেন ইরানত্যাগী লেখক শোলে ওলপে

পরিস্থিতি যে প্রহসনতুল্য হবেই, তা যেন বুঝেছিলেন তিনি। তাই অল্প অল্প করে নিজের চারপাশের মানুষজনের মনের ভাবে কিছুটা বদল আনতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই পারসি ভাষায় লেখা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কবিতা অনুবাদ করতে শুরু করেন তিনি।

জয়পুর লিটারেচর ফেস্ট-এ শোলে ওলপে। ছবি: সুচন্দ্রা ঘটক।

জয়পুর লিটারেচর ফেস্ট-এ শোলে ওলপে। ছবি: সুচন্দ্রা ঘটক।

সুচন্দ্রা ঘটক
জয়পুর শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২০ ১৯:১২
Share: Save:

সময়টা যেমনই হোক, সুখে থাকা সহজ নয় দুনিয়ার কোনও প্রান্তেই। তবে সময়ের এই চেহারা বদলাতে গেলে অনেক ভালবাসা দিয়ে ভরে দিতে হবে চারপাশটা। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কত দিন আর কাটবে? নিজের জন্মস্থান ইরান ছেড়ে মার্কিন মুলুকে বহু বছর কাটিয়ে ফেলেছেন কবি-সঙ্গীতকার-নাট্যকার-অনুবাদক শোলে ওলপে। দফায় দফায় দেখেছেন ভারতের নানা প্রান্ত। সব দেখেশুনে এখন তাঁর মনে হয়, পরিস্থিতি কোথাওই আলাদা নয়। বর্তমান ইরান, বর্তমান ভারত, এমনকি, এ সময়ের আমেরিকা— সবই একই মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ।

এ বছর জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভালে এসেছেন তাঁর মতো দেশছাড়া মানুষদের ভাবনা-জীবন নিয়ে কথা শোনাতে। সঙ্গে শোনাবেন নিজের গানও। সে সবের আগে আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে একান্ত আড্ডায় বললেন, ‘‘কঠিনের মোকাবিলা করতে গেলে সবার আগে ‘মোকাবিলা’ শব্দটা বদলে ফেলতে হবে। আমাদের রোজের শব্দচয়নে কেমন যেন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব ঢুকে গিয়েছে। তাই আমরা চাইলেও যুদ্ধ থেকে বেরোতে পারি ন‌া।’’

ইরান ছেড়েছেন তিনি ১৯৭৫-এ। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩। তার পরে ত্রিনিদাদ, ইংল্যান্ড ঘুরে পরিবার পৌঁছেছে আমেরিকায়। জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ হয়নি। পালিয়ে আসতে হয়েছিল পরিবারকে। তবে বন্ধুরা এখনও অনেকেই থাকেন সে দেশে। তাই মন পড়ে আছে সেই সংস্কৃতিতে। এখনও বলতে ভাল লাগে, পৃথিবীর সবচেয়ে শিক্ষিত দেশগুলির মধ্যে তাঁর নিজের দেশ অন্যতম। তবে ওই পর্যন্তই। তার পরেই যে ভাবতে হয়, এত শিক্ষার পরে এমন কেন হল? তাই আজ আর মনে হয় না যে, জন্মের ভিত্তিতে কোনও জায়গা নিজের ঘর বলে মনে হওয়ার কারণ আছে। যেখানে শান্তি পাওয়া যায়, সেটাই তো ঘর।

আরও পড়ুন: সরস্বতী পুজোয় বৃষ্টির সম্ভাবনা, আগামী দু’দিন কনকনে ঠান্ডা রাজ্যে

শান্তি দিয়েছে আমেরিকা?

দুনিয়ার চোখে তিনি ইরানি-মার্কিনী লেখক। কারণ এই দু’টি দেশেই তো মূলত থেকেছেন তিনি। এখন আমেরিকার নাগরিকও। তবে দেশের গণ্ডি, নাগরিকত্ব— এ সবের ফাঁদে নিজের পরিচয়কে বেঁধে ফেলতে চান না। তিনি ঘর খুঁজে নিয়েছেন কাজের মধ্যে। সাহিত্যের মধ্যে। তাঁর মতো বার বার যাঁদের ঘর বদলে যায় রাজনৈতিক, সামাজিক চোখরাঙানির কারণে, তাঁদের কথা বলতে শুরু করেছেন নিজের সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে।

তার মাধ্যমে কি ঘর হয়ে উঠেছে নতুন দেশ?

শোলে ওলপে।

পশ্চিমের ‘সাদা সমাজ’ কোনও ভাবেই রঙিন মানুষদের নিজের ঘরের লোক বলে মনে করেনি, এখনও করে না। তবে তিনি সে দেশের কাছে কৃতজ্ঞ। নিজেরা জীবন ফিরে পেয়েছেন যে। ইরানে থাকলে হয়তো বেঁচেই থাকতেন না। বলেন, ‘‘সে সময়ে তো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধরে ধরে মেরে ফেলা হচ্ছিল। বিশেষ করে বাহাইদের। আমার পরিবারও সে ধর্মেই বিশ্বাসী।’’

তবে আমেরিকায় তাঁদের পরিচয় ‘টেররিস্ট’-দের দেশের লোক বলেই। ‘‘আমাদের মতো বিভিন্ন রঙের চেহারা যাঁদের, যেন তাঁদের সকলের বাড়িতেই সন্ত্রাসবাদীরা জন্মায়। আর সাদা চামড়ার মানুষের ঘরে জন্মায় না!’’ পরিচয় ঘিরে এই রাজনীতি দেখে অবাক লাগে তাঁর। তাই নিজের মাতৃভূমির সাহিত্যকে প্রতিবাদের হাতিয়ার করে নিয়েছেন তিনি। তবে লড়ে নেওয়ার জন্য নয়। অন্য একটা ভাবনার পরিবর্তে আর একটা ভাবনার দরজা খুলে দিতে হবে। সেটাকেই সবচেয়ে বড় কাজ বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মনে হয়, ‘‘ভারত একটা অসম্ভব অশান্ত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে অশান্তি শুধু এ দেশের নয়। এক-এক দেশে এক-এক রকমের।

আরও পড়ুন: নির্ভয়াকাণ্ড: তিহাড় জেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে ফের আদালতে দণ্ডিতদের আইনজীবী

তাঁর চিন্তা, ইরানের অশান্তির কারণে আমেরিকায় ফিরতে ঝঞ্ঝাট হতে পারে তাঁর। যত দিন না মানুষ মনুষ্যত্বে বেশি ভরসা করবে এবং নেতাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে না সর্ব ক্ষণ, তত দিন পরিবর্তন ঘটবে না। তত দিন পর্যন্ত হংকং, সিরিয়া, আমেরিকা, ইরান, ভারত— সব একই সমস্যার আলাদা আলাদা নাম হয়ে থাকবে। আরও আরও মানুষ হতে থাকবেন ঘরছাড়া। যেমন ভাবনা এখন এক ভাবে ভারতীয় সরকার ভাবছে, আর এক ভাবে দফায় দফায় ভাবা হয়েছে ইরানে। ধর্মীয় পরিচয়ের নামে নানা ভাবে বিভাজনের বাণী ছড়িয়েছে দুনিয়া জুড়ে। শোলে বললেন, ‘‘আমার পরবর্তী নাটক কয়েক দিনের মধ্যে মঞ্চস্থ হবে হলিউডে। সেটির নাম ব্রাদার্স অ্যাট দ্য ক্যানেডিয়ায় বর্ডার’। আমার ভাইয়েরা কী ভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছিল কানাডার সীমান্তে, তা নিয়েই নাটক। তবে এটা একটা কমেডি। কারণ গোটা পরিস্থিতিটাই যে হাস্যকর। মুখ ভার করে বসে থেকে লাভ নেই।’’

পরিস্থিতি যে প্রহসনতুল্য হবেই, তা যেন বুঝেছিলেন তিনি। তাই অল্প অল্প করে নিজের চারপাশের মানুষজনের মনের ভাবে কিছুটা বদল আনতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই পারসি ভাষায় লেখা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কবিতা অনুবাদ করতে শুরু করেন তিনি। হাসতে হাসতে শোলে বলেন, ‘‘মজার কথা জানো? সেই সব কবিতা পড়ে কিছু লোকের মনে হয়নি যে সেটা কোনও টেররিস্টের লেখা। ইংরেজিতে পড়েছে তো, তখন দিব্যি লেগেছে। হইহই করেছে, ফারুগ ফারোগজাদের মতো এক জন শক্ত মনের মহিলার কথা পড়ে। অথচ তিনিও তো ইরানেই জন্মেছিলেন!’’

তপ্ত কণ্ঠে শোলে জানান, আসলে দুনিয়াটা ট্রাম্পেরই মতো। নিজের সুবিধেমতো চলে। যাকে পারে প্রয়োজনে বন্ধু বানায়, আবার যাকে পারে সুযোগ বুঝে সমস্যায় ফেলে। এদের সকলকে এত গুরুত্ব দিলে চলবে না। নিজের বেঁচে থাকার একটা পথ খুঁজে নিতে হবে। তার জন্য প্রতিবাদের একটা বিকল্প ভাষা খুঁজে নিতে হবে। যুদ্ধের ভাষায় কথা বললে হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE