বাবার ছবি হাতে অনিল। —নিজস্ব চিত্র।
দেড় লক্ষ কত টাকা?
তেলঙ্গনার জনগাঁও জেলার নরমেট্টা গ্রামের প্রথম বর্ষের কলেজ ছাত্র অনিল রামালু শুধু জানেন, ওই টাকাটা থাকলে তাঁর বাবা ‘পালাতেন’ না! নাহ্, বিদেশে নয়।
ছেলের কথায়, ‘‘বাবা ঘোরের মধ্যে ছিল। নিজের মনে কথা বলত। এক সকালে খেতের পাশে থাকা গাছে ঝুলতে দেখা যায় বাবাকে।’’
বছর চারেক আগে অনিলের বাবা ইলাইয়া লাখ খানেক টাকা ধার করেছিলেন তুলো চাষের জন্য। কিছুটা সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে। কিছুটা দেয় মহাজন। ১০০ টাকায় বছরে ২৪ টাকা সুদ। পরপর দু’টো অনাবৃষ্টি। ফসল নষ্ট। সুদে-আসলে দাঁড়ায় দেড় লক্ষে। শুরু হয় ব্যাঙ্কের লোকদের তাগাদা। বাড়ি বয়ে হুমকি দিয়েছিল মহাজনেরাও। রাত-বিরেতে, ভরা হাটে, খেতে তাঁর অপমান দেখেছেন গ্রামের আর পাঁচ জন।
মাস তিনেক সহ্য করেছিলেন ইলাইয়া। বাড়ি-জমি, স্ত্রী, তিন সন্তান ফেলে কোন দেশে আর ‘পালাবেন’? অতএব... গাছের ডাল। সেই গাছের পাশ দিয়েই এখন খেতে হাল দিতে যান অনিল। কলেজ ছাত্রটি এখন বাবার মতোই চাষি। কিছু মাফ, কিছু আর্থিক সাহায্যে গত দু’বছরে ঋণ অনেকটাই শোধ হয়ে এসেছে। কিন্তু অনিশ্চয়তা পিছু ছাড়েনি। বর্ষার জলে ধান চাষ ভরসা। তাতে বছরের খোরাকিটুকুই মেলে। তাই পড়াশুনোর পাশাপাশি মজদুরি, মা-বোনের বিড়ি বানানো— এতেই কোনওমতে সংসারের বাকি খরচ সামলায় অনিলের পরিবার। অনিলের কথায়, ‘‘সরকার সেচের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। দু’ফসলি হলে তবেই চাষবাস করব। না হলে জমি বেঁচে শহরে চলে যাব।’’ দু’বছর পরে স্নাতক হবে অনিল। সেই সময়টুকু দেখবে সে। নইলে বাপ-দাদার জীবিকা ছেড়ে অন্য পথ।
অনিলের বাড়ি থেকে মেরেকেটে ১০০ মিটার। কোন্নে রমেশ আত্মহত্যা করেছিলেন তিন লক্ষ টাকার দেনায়। পুত্রবধূ লাবণ্য বলেন, ‘‘খালি তাগাদা দিত মহাজন। রাস্তায়-ঘাটে। যেখানে দেখা হত। শেষে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন শ্বশুরমশাই।’’ বাবার মৃত্যুর পর খেতে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন রমেশের ছেলে। মজদুরিই ভরসা। লাবণ্যের কথায়, ‘‘মাটির তলায় জল নেই। সেচের ব্যবস্থা নেই। চাষটা হবে কী করে শুনি!’’
নরমেট্টার হাজার জনের গ্রামে আত্মহত্যার তালিকা নিছক ছোট নয়। গত তিন-চার বছরে অন্তত ১২ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। আর গোটা রাজ্যে গত তিন বছরে ৩০২৬ জন কৃষক লোকসানের কারণে নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন বলে হিসেব একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার। তাই ভোটে জিততে কৃষকদের এক লক্ষ টাকা ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও। জিতেওছেন হই হই করে। কিন্তু বিরোধীরা তাঁকে ছাড়ছেন না। কেন?
জনগাঁও থেকে নরমেট্টা যাওযার পথেই ধরা পড়বে কারণটা। পাথুরে জমি, জলের অভাবে খেতেই শুকিয়ে যাচ্ছে ফসল। অন্য কয়েকটি রাজ্যে ফসলের দাম না পাওয়া যেখানে বড় সমস্যা, তেলঙ্গানার মূল সমস্যা জলের অভাব। লাগাতার অনাবৃষ্টি, সেচের অনুপস্থিতি, অপরিকল্পিত বোরিং-এর ঠেলায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে গিয়েছে কয়েকশো ফুট। রাজ্যের অধিকাংশ জেলাই খরাপ্রবণ।
সমস্যা মেটাতে দু’টি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। পানীয় জলের জন্য ‘মিশন ভগীরথ’ এবং খেতের জন্য ‘মিশন কাকাতিয়া’। ঠিক হয়েছিল, প্রাচীন কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের ধাঁচেই গোটা রাজ্যের জলাশয় সংস্কার করে সেচের ব্যবস্থা করবে সরকার।
যদিও কংগ্রেসের মুখপাত্র শ্রবণ দাসাজুর দাবি, ‘‘রাজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামে পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ঘরে-ঘরে কল বসেছে। কিন্তু জল আসে না। শাসক দল ঘনিষ্ঠ এক ঠিকাদারকে ফায়দা পাইয়ে দিতেই তো সব করা হল!’’ অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছে সরকার। আবার ‘মিশন কাকাতিয়া’র আওতায় মুখ্যমন্ত্রীর ভাগ্নে হরিশ রাওয়ের এলাকায় প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘লিফট ইরিগেশন’ কালেশ্বরম প্রকল্প। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের সমস্যা, পরিকল্পনার গলদে সেই প্রকল্প এখনও শুরু করা যায়নি। বিরোধীরা বলেন, উত্তর তেলঙ্গানায় রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিধানসভা কেন্দ্র। ফলে সেখানে তা-ও জলাশয় সংস্কার হয়েছে। কিছুটা সবুজের ছোঁয়া লেগেছে খেতে। বাকি রাজ্য শুকনোই।
আবার প্রথম বার ক্ষমতায় এসেই চাষের খেতে বিদ্যুৎ ‘ফ্রি’ করে দেন কেসিআর। সাড়ে চার বছরের মাথায় তার কুফল দেখা দিয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সুযোগে বড় চাষিরা ‘বোরিং’ করে ভূ-গর্ভস্থ জল তুলে নিচ্ছেন। সঙ্গতিহীনদের খেত শুকনো।
মেহবুবনগরের ভূমপল্লি গ্রামের কৃষক এম গাইদু বলছিলেন, ‘‘গত বছর এক লাখ টাকা খরচ করে কুয়ো খুঁড়েছিলাম। ৪৫০ ফুট নীচেও জল পাইনি। শেষে খোঁড়া বন্ধ করে দিই।’’ জমি, তিন সন্তান, স্ত্রীকে ছেড়ে অনিল তা-ই ‘পালিয়ে’ই যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy