আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর আগের কথা। তখনও সুলতানি আমল চলছে। ১৪৫৬ সাল। দিল্লির মসনদে রাজ করছেন বহলুল খান লোদী। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে। রাজত্ব করছেন সঙ্গম-রাজ মল্লিকার্জুন। আর ঠিক সেই সময়েই পৃথিবীর আকাশে দেখা দিয়েছিল হ্যালির ধূমকেতু— কয়েকশ বছর ধরে পৃথিবীর ইতিহাসের সাক্ষী যে।
সম্প্রতি বিজয়নগর আমলের একটি তাম্রলিপিতে একটি ধূমকেতুর উল্লেখ পেয়েছেন পুরাতাত্ত্বিকেরা। ঘটনাচক্রে, ওই সময়েই পৃথিবীর গা-ঘেঁষে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছিল হ্যালির ধৃমকেতু। ফলে মনে করা হচ্ছে, তাম্রলিপিতে উল্লিখিত ধূমকেতুটি ছিল হ্যালির ধূমকেতুই। তাম্রলিপিটি অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈলমে মল্লিকার্জুনস্বামী মন্দিরে সংরক্ষিত রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর আগে ভারতের ইতিহাসে হ্যালির ধূমকেতুর কোনও লিখিত উল্লেখ মেলেনি। এই প্রথম তার খোঁজ পেলেন পুরাতাত্ত্বিকেরা।
এর আগে দেশবিদেশের বিভিন্ন প্রাচীন শিলালেখ ও ঐতিহাসিক নিদর্শনে হ্যালির ধূমকেতুর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। তবে ভারতে এই প্রথম। হাজার হাজার বছর ধরে সূর্যের চারপাশে ঘুরে চলেছে এই ধূমকেতু। প্রতি ৭৬ বছরে একবার সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে সে। ফলে প্রতি ৭৬ বছর অন্তর পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায় একে। ১৬৮২ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি প্রথম খাতায়কলমে প্রমাণ করেন, এই ধূমকেতুটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফিরে ফিরে আসে। হ্যালিকে সঠিক প্রমাণ করে দিয়ে ১৭৫৮ সালে ফের পৃথিবীর আকাশে আবির্ভাব ঘটে এই ধূমকেতুর, ঠিক ৭৬ বছর পর। কিন্তু তার আগে, ১৭৪২ সালেই মারা গিয়েছেন এডমন্ড। তাঁর নামানুসারেই পরবর্তী কালে ধূমকেতুটির নামকরণ করা হয়।
আরও পড়ুন:
ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)-এর এপিগ্রাফি বিভাগের ডিরেক্টর কে মুনিরত্নম রেড্ডি সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’কে বলেন, ‘‘যে তাম্রলিপিতে এই ধূমকেতু উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে, তা লেখা হয়েছিল সংস্কৃত ভাষায়, দেবনাগরী লিপিতে। তাতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, ১৪৫৬ সালে আকাশে একটি ধূমকেতুর আবির্ভাব হয়েছিল। সঙ্গে উল্কাবৃষ্টিরও উল্লেখ রয়েছে— যা ১৪৫৬ সালে হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাবের সঙ্গে মিলে যায়।’’ মুনিরত্নম জানাচ্ছেন, তাম্রলিপিটি ১৩৭৮ শকাব্দের আষাঢ় মাসের ১১ তারিখের। অর্থাৎ সে দিন ছিল সোমবার, ২৮ জুন, ১৪৫৬ সাল। তাম্রলিপিতে লেখা রয়েছে, ‘‘ধুমকেতুর আবির্ভাব (ধূমকেতু মহোৎপাত শান্ত্যর্থম) এবং উল্কাবৃষ্টির (প্রকাশ্যায় মহোৎপাত শান্ত্যর্থম) প্রভাবে যে মহাবিপর্যয় ঘটতে চলেছে, তা প্রশমিত করার জন্য বিজয়নগরের শাসক মল্লিকার্জুন লিঙ্গনার্য নামে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে একটি গ্রাম দান করলেন।’’ মুনিরত্নম আরও জানাচ্ছেন, মধ্যযুগীয় ভারতে ধূমকেতু এবং উল্কাবৃষ্টির আবির্ভাবকে অশুভ বলে মনে করা হত। সেই অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পেতেই ব্রাক্ষণকে গ্রাম দান করেছিলেন বিজয়নগরের রাজা। তাম্রলিপিতে উল্লিখিত হস্তিনাবতী ভেমঠের কেলঝাসিমার অন্তর্গত সিঙ্গাপুর নামক যে গ্রামটি অগ্রহার হিসাবে দান করা হয়েছিল, তা সম্ভবত বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের কাডাপা জেলার গালিভিডু মণ্ডলমের কাদিয়াপুলঙ্কা। তবে মুনিরত্নমের কথায়, এর আগে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় গ্রন্থগুলিতে ‘ধূমকেতু’ শব্দের উল্লেখ থাকলেও এই প্রথম কোনও তাম্রলিপিতে এ ধরনের উল্লেখ পাওয়া গেল। ফলে এই আবিষ্কারকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন পুরাতাত্ত্বিকেরা।