মনে করুন, পার্কে হাঁটতে গিয়েছেন বা পোষ্যকে নিয়ে এক চক্কর দিতে বেরিয়েছেন। মন্দিরে পুজো বা মসজিদে প্রার্থনা করতে গিয়েছেন। স্কুলে বা কলেজে ঢুকছেন। সারা দিনে যে সব জায়গায় যেতে পারেন, সেখানে গেলেই চোখে পড়ছে আপনার এলাকায় কবে ভোট জানিয়ে বুথে যাওয়ার আবেদন। কলকাতায় সচরাচর ভোট ঘিরে এমন সাজ সাজ রব টের পাবেন না। কিন্তু বিহারে ঘুরলে এ বার বোঝা গিয়েছে, ভোট একটা হচ্ছে বটে!
বিহারে এ বারের বিধানসভা নির্বাচনকে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ করে তোলার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েছে নির্বাচন কমিশন। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে ভোটের পক্ষে প্রচার থেকে শুরু করে বুথকে বিয়েবাড়ির মতো সাজিয়ে তোলা— বাদ যায়নি কোনও কিছুই। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়া চলাকালীন বিহারে এসে চোখে পড়েছিল, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে কমিশনের ট্যাবলো। ভোটার তালিকা সংশোধনে কী ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে, তার প্রচার ছিল ওই অভিযানে। আর এখন এককালের মাওবাদী-অধ্যুষিত জহানাবাদ, অরওয়ল থেকে শুরু করে মন্দির-শহর গয়া বা রাজধানী পটনা, সর্বত্রই নির্বাচনের নির্ঘণ্ট অনুযায়ী ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে, দেওয়ালে লিখে ভোট-প্রক্রিয়ার দিকে জনতার নজর টেনে আনার চেষ্টা চালানো হয়েছে কমিশনের তরফে।
ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রচার। —নিজস্ব চিত্র।
আপাতদৃষ্টিতে সেই প্রয়াসের ফলও মিলেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বিহারের কোনও সাধারণ নির্বাচনে ভোটদানের হার এ বারই সর্বাধিক— ৬৬.৯১%। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বিহারে এই যাত্রায় মহিলাদের ভোটের হার (৭১.৬%) পুরুষদের চেয়ে প্রায় ৮% বেশি। বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এসআইআর-এ অনেক নাম বাদ গিয়েছে ভোটার তালিকা থেকে। তাই ভোটদানের শতাংশ হিসেবও বেশি দেখাচ্ছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি সত্যি। তবে এই বিশ্লেষণের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন বিরোধীদের মহাগঠবন্ধনের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তেজস্বী যাদব। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভোটদানের শতাংশ হিসেবে ওঠা-নামা থাকেই। কিন্তু গত বারের চেয়ে এ বার ৭২ লক্ষ বেশি ভোটদাতা মত দিয়েছেন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।’’
বিহারের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) বিনোদ সিংহ গুঞ্জিয়াল ও পুলিশের ‘নোডাল’ আধিকারিক কুন্দন কৃষ্ণন। —নিজস্ব চিত্র।
বিহারের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) বিনোদ সিংহ গুঞ্জিয়ালের কথায়, ‘‘ভোটার তালিকা পরিষ্কার করার জন্য এসআইআর হয়েছিল। সাধারণ মানুষ এবং সব দলের সহায়তা আমরা পেয়েছিলাম। তার প্রভাব অবশ্যই ভোটদানে পড়েছে। মোট ৭ কোটি ৪৫ লক্ষ ভোটার এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সুষ্ঠু ভাবে ভোট হয়েছে।’’ সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য অন্য দিক থেকে ব্যাখ্যা করছেন, ‘‘এসআইআর-এ ভোটার তালিকায় নাম রাখতে পারা ছিল বিহারের মানুষের প্রথম পরীক্ষা। নাম ওঠার পরে পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপ হল ভোটের অধিকার প্রয়োগ করা।’’ ভোটার থাকার জন্য কাগজপত্র হাতড়ে বিস্তর কাঠখড় পোড়ানোর পরে ভোট দেওয়ার তাগিদ যে বেড়েছে, নানা প্রান্তে আম জনতার মনোভাবও তা-ই বলছে।
দু’দফায় মোট ৯০ হাজার ৭৪০টি ভোট-কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হলেও কোথাও পুনর্নির্বাচনের দাবি ওঠেনি। প্রথম দফায় বুথের বাইরে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি অশান্তির ঘটনা থাকলেও দ্বিতীয় দফায় সেই অভিযোগও নেই। অতীতে ছপরা জেলের সংঘর্ষ বা আনন্দ মোহনের গ্রেফতার সামলে আসা আইপিএস কুন্দন কৃষ্ণন এখন বিহার পুলিশের এডিজি (সদর) এবং এ বারের ভোটে পুলিশের ‘নোডাল’ আধিকারিক। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বাইরে দু-একটা ছোটখাটো ঘটনা থাকলেও বুথে কোনও গোলমাল হয়নি। ভিতরে-বাইরে ক্যামেরা ছিল। ভোট-কর্মীদের সব ধরনের যাতায়াতে জিপিএস ট্র্যাকিং রাখা হয়েছিল। যেখানে নৌকোয় ভোট-কর্মী এবং সামগ্রী পাঠানো হয়েছে, সেখানেও একই ব্যবস্থা ছিল। সব রকম ভাবে নজরদারি চালানো হয়েছে।’’ কুন্দন জানাচ্ছেন, বিহারে কয়েক দশকে এই প্রথম কোথাও ভোট-কর্মীদের ‘হেলি ড্রপিং’ (কপ্টারে পাঠানো) করতে হয়নি।
এই গোটা বন্দোবস্তের ‘ফল’ উপভোগ করছেন দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার! তাঁর দাবি, ‘‘এসআইআর থেকে ভোট, বিহারে ভোটারেরা ঐতিহাসিক ভাবে সবটা সম্পন্ন করেছেন। ভোটারকে সচেতন ও সক্রিয় রাখা কমিশনের দায়িত্ব। কমিশন সেটা পালন করেছে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)