পাশের দেশটাকে স্বাধীন করতে জোর লড়াই চলছে। ভাসাভাসা ধারণা ছিল বছর বারোর ছেলেটির। কৌতূহলের বশে হাজির হয়েছিল বাড়ির কাছেই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে ডেকে নিয়ে যান এক জন। বলেন, পরের দিন সে যেন পড়ার বই নিয়ে আসে।
একষট্টিতে পা দেওয়া প্রবীণ শিক্ষক আব্দুল ছবুরের এখনও স্পষ্ট মনে আছে, পরে বইখাতা নিয়ে সেই ক্যাম্পে যেতে, সে দিন আলাপ হওয়া মানুষটি, ‘ইমদাদুল স্যর’ পড়াতে বসেছিলেন। অঙ্ক দেখিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওর মতো তাঁর বাড়িতেও ভাইবোন রয়েছে।
উনপঞ্চাশ বছর পর সেই ‘ইমদাদুল স্যরের’ কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বহু কথার ভিড় প্রবীণ ছবুরের মনে। বলে চলেন, “কয়েক দিন পর বলেছিলেন, ক্যাম্পে আর এসো না। আমরা অপারেশনে যাব। এর চার দিন পরে ক্যাম্পে গেলে সবাই আমাকে বলেন, ইমদাদুল স্যর মারা গিয়েছেন। শুনে হতভম্ব হয়ে যাই। ক্যাম্পের অন্যরা জানান, বাংলাদেশের সাগরনাল এলাকা থেকে দু’জন মুক্তিযোদ্ধার দেহ আনতে গিয়ে ইমদাদুল স্যরকে পূর্ব-পাকিস্তানের সেনারা মেরে ফেলেছে।
শহিদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমদাদুল হক শুধু নয়, আরও চার জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধি এত দিন পরে খুঁজে পেয়েছেন ছবুর। কবরস্থানটি ধর্মনগরের কাছে, কদমতলা ব্লকের চল্লিশ দ্রোন এলাকায়। কদমতলা থেকে দুরত্ব মাত্র দেড় কিলোমিটার। ছবুর বলেন, “দেশ স্বাধীন করতে প্রাণ দিয়েছেন এঁরা। এত দিন এখানে সকলের অগোচরে, অযত্নে রয়ে গিয়েছে তাঁদের সমাধি। খবর পাননি তাঁদের আত্মীয়স্বজনও।”
ছবুর জানিয়েছেন, সমাধিফলকের লেখা অনুযায়ী তিন জনই ছিলেন ৮ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এঁদের এক জন হলেন সিপাহি মোকমেদ আলি (রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৩৯৪০০৮৮)। বাড়ি ছিল কুমিল্লা জেলায় গোয়ালপাড়ার কিসমত নয়াপাড়ায়। তিনি শহিদ হন ১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর। দ্বিতীয় জন জওয়ান মহম্মদ জামালউদ্দিন (রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৩৯৫০০১৭)। তিনি শহিদ হয়েছেন ১৯৭১-এর ১৭ অক্টোবর। বাড়ি কুমিল্লা জেলার বিজয়নগর গ্রামের পারারবানে। তৃতীয় জন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমদাদুল হক। বাড়ি ছিল কুমিল্লায়। শহিদ হয়েছিলেন ১৯৭১-এর ১১ অক্টোবর। এঁদের সমাধির পাশেই শায়িত রয়েছে আর দুই মুক্তিযোদ্ধার দেহ। কিন্তু কালের গ্রাসে নষ্ট হয়ে গিয়েছে সমাধিফলক। ফলে তাঁদের নামধাম এখনও জানা যায়নি।
সম্প্রতি দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরান ত্রিপুরা সফরে এসেছিলেন। তাঁকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, ত্রিপুরার সহকারি হাইকমিশনারকে এই বিষয়ে খোঁজ নিতে বলবেন। সন্ধান করতে বলবেন, ত্রিপুরার আর কোথায় ছড়িয়ে রয়েছে এমন মুক্তিযোদ্ধার সমাধি।
এর আগে ত্রিপুরার ধলাই জেলার আমবাসায় মুক্তিযুদ্ধের শহিদ হামিদুর রহমানের সমাধির খোঁজ মিলেছিল। ২০০৭-এর ৯ ডিসেম্বর ভারত এবং বাংলাদেশের উদ্যোগে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁর দেশে। শিক্ষক ছবুরের এখন প্রত্যাশা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে ২০২১-এর মার্চে। তার আগে যেন এই পাঁচ শহিদের দেহাবশেষ পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেওয়া হয় তাঁদের পরিবারের কাছে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি যেন ফিরে পায় তার বীর সন্তানদের।