একটা গাড়ি এসে বস্তির থেকে কিছু দূরে বড় রাস্তায় শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে রোজ সকাল সকাল। আবার কখনও সন্ধ্যার মুখেও। সে গাড়ির কোনও নেমপ্লেট নেই। ভিতরে বসে সিগারেট ফোঁকেন সাধারণ শার্ট-ট্রাউজ়ার্স পরা মানুষ। একটু হাট্টাগাট্টা চেহারার। ভাবটা— কোনও তাড়া নেই, হাওয়া খেতে এসেছেন তাঁরা!
ওই রাস্তা দিয়ে গুরুগ্রামের বহুতল আবাসনে অথবা বিলাসবহুল বাংলোগুলিতে সকালে কাজে যান বা দিনান্তে ফেরেন দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরের হামিদুর রহমান, মুর্শিদ, সিরাজুল আলমরা। পথে তাঁদের থামিয়ে টুকটাক খোশগল্প, পরিচয়, নাম, মাতৃভাষা জেনে নিতে নিতেই বসানো হয় গাড়িতে। তার পরে সে গাড়ি কোন অজ্ঞাতবাসের দিকে চলতে থাকে, হামিদুররা ঠাহর করতে পারেন না। বহু মাইলপেরিয়ে কোন এলাকার ঘরে তাঁদের ঢোকানো হয়, তা-ও অজানা। যা বোঝা যায় তা হল, ‘বাংলাদেশি’ বলে তীব্র গালাগালি এবং মারধর। হুমকি দেওয়া হয়, ফিরে না গেলে বিপদ বাড়বে। এক দিন বা দেড় দিন চলে এই পীড়ন, তার পরে আধমরা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। পথঘাট হাতড়ে তাঁরা ফেরেন নিজনিজ বস্তিতে।
এই ভাষ্য গুরুগ্রামের বহুতলের ছায়ায় দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকা বেঙ্গলি মার্কেটের। নামেই মার্কেট, আসলে সাত-আটশো ঘরের বস্তি। যে বস্তি আজ উজাড়। ৭০ ভাগ মানুষ ওই নেমপ্লেটহীন ‘গাড়িধরার’ আতঙ্কে ফিরে গিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে, নিজ নিজ গ্রামে। অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের কথা জেনেও। যাঁরা আছেন, তাঁরা লরিতে সবার জিনিসপত্র তুলতে ব্যস্ত। ধ্বংসস্তূপের মতো পড়ে রয়েছে গোটা বস্তি।
‘‘আমাকে প্রথম তোলে এই বস্তি থেকে। জুন মাসের আঠাশ তারিখ। ঠিক অপহরণ করার মতো করে, বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে সকাল বেলায়।’’ পাকানো চেহারার হামিদুল রহমান, বাড়ি দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন থানা এলাকায়। গাড়ি সাফাইয়ের কাজ করেন। প্রথমে তাঁকে বলা হয়, কয়েক জন বাংলাদেশিকে ধরিয়ে দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে। তার পরে চাপ দেওয়া হয় ‘স্বীকার’ করতে যে, তিনি আসলে বাংলাদেশি। হামিদুল বলছেন, ‘‘আধার কার্ড, ভোটার কার্ড দেখিয়েও রেহাই নেই। দেখুন, এখনও ভাল করে হাঁটতে পারছি না এমন মেরেছে পায়ে। এক দিন পরে যখন ছাড়ে, খুঁড়িয়ে বাইরে এসে শুনি জায়গাটা নাকি সোনিপত, যেখানে নিয়ে গিয়েছিল।” অভিযোগ, হামিদুরের মতো জনা ত্রিশ মানুষকে ঠিক একই ভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে, চাপ দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয় ‘স্বীকার করাতে’। প্রয়োজনীয় পরিচয়পত্রে কাজ হয়নি। মহল্লার প্রশ্ন, ‘বাংলা ভাষায় কথা বলি বলেই কি আমরা বাংলাদেশি?’
ছোট ছোট খুপরিতে পুতুলের মতো সংসার চলছিল, এখন সেটাও বন্ধ। অধিকাংশ বাড়িতে তালা। বাইরে গণহারে চাল সেদ্ধ হচ্ছে। গাড়িতে জিনিসপত্র তোলার তাড়াহুড়োর মধ্যেই সেলিম খান বলছেন, ‘‘এক দিকে এই বস্তির মালিক (হরিয়ানার) ঘাবড়ে গিয়ে জবাব দিয়েছেন। বলছেন, ‘তোমরা এখন চলে যাও, কাগজপত্র ঠিক করে আবার এসো। আমি এই ঝামেলায় পড়তে চাই না।’ কিন্তু কাগজপত্র দেখানোর পরেও তো মার পড়ছে। ফিরে না গিয়ে উপায় কী?’’
প্রায় বিশ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাজের অভাবে এই গুরুগ্রামে জড়ো হয়েছিলেন মালদহ-দিনাজপুরের মানুষরা। এখানেই অভিজাততন্ত্রের সাফাই-সহ হাজারো কাজ করে নির্বাহ। এ ভাবেই বাচ্চাদের পড়ানো, তাদের বেড়ে ওঠা। সেই জীবিকার ভিটে আজ হঠাৎ ছেড়ে যাওয়ার শোক অনেক ক্ষেত্রেই বদলে যাচ্ছে ক্রোধে। আমিনা বলছেন, "নিজের গাঁয়ে, রাজ্যে যদি কাজ পেতাম, এত দূরে মরতে ছুটে আসতাম? যাদের মেয়ে রয়েছে তারা মেয়ের বিয়ে দেবে কী ভাবে ওখানে থেকে? মেহনত করার সুযোগও নেই বাংলার গ্রামে। যাদের জমিজিরেত নেই, তাদের তো কাজের অভাবে ফলিডল খাওয়ার জোগাড়। মমতাদিদি তো জিতে চলেছেন, মার খাচ্ছি আমরা। এখান থেকে অনেকে গিয়ে ভোটও দিয়ে এসেছি। সেই সময় পার্টির নেতারা কাজে লাগায়, অন্যের সঙ্গে লড়াই করায়। ভোট শেষ, আমাদের কোনও ব্যবস্থা হয় না।’’
স্থানীয় পুলিশ অবশ্য বিষয়টিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ বলে দায় ঝেড়ে ফেলছে। পুলিশ মুখপাত্রর বক্তব্য, ‘‘আমাদের কাছে উপর থেকে নির্দেশ এসেছে খতিয়ে দেখতে এই এলাকাগুলিতে বিদেশিরা বেআইনিভাবে রয়েছেন কি না। যাঁরা প্রকৃত নাগরিক, তাঁদের তো ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।" হিংসার অভিযোগের জবাবে পুলিশ সূত্রের বক্তব্য, 'সর্বত্র সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে, যেখানে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কোনও অভিযোগ তো জমা পড়েনি। যাঁরা সন্দেহের তালিকায় নেই, তাঁদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়েও দেওয়া হচ্ছে।'
প্রশাসন যা-ই বলুক, চোখে দেখে বোঝা যচ্ছে আতঙ্ক থম মেরে আছে বস্তিগুলিতে। সাধ করে কেউ বাড়ি ও জীবিকা ছেড়ে পালিয়ে যায় না।
(চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)