বাবা দীপক যাদবের হাত ধরেই টেনিসের দুনিয়ায় পা রেখেছিলেন হরিয়ানার জাতীয় স্তরের টেনিস খেলোয়াড় রাধিকা যাদব। বাবা দীপকই তাঁর এগিয়ে চলার রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। রাধিকার খেলা, প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে প্রতিযোগিতা— সব দিক থেকে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন দীপক। কন্যার টেনিস প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলতেও সহযোগিতা করেছিলেন। যে মানুষটি নিজে হাতে তাঁর কন্যার স্বপ্ন গড়ে দিয়েছিলেন, কী এমন হল যে সেই তিনি নিজে হাতে কন্যার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিলেন? কন্যার জীবন কেড়ে নিতেও কুণ্ঠাবোধ করলেন না?
২০০০ সালের ২৩ মার্চ রাধিকার জন্ম হরিয়ানার গুরুগ্রামে। একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে পড়াশোনা করেন। তার পর ২০১৮ সালে বাণিজ্যবিভাগ নিয়ে দ্বাদশ পাশ করেন। ছোটবেলা থেকেই টেনিসের প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। আর সেই উৎসাহ জুগিয়েছিলেন রাধিকার বাবা দীপকই। বছর পঁচিশের রাধিকা হরিয়ানার সেরা পাঁচ টেনিস খেলোয়াড়ের মধ্যে এক জন ছিলেন। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশন-এর মহিলাদের ডবলসে রাধিকার র্যাঙ্ক ছিল ১১৩। ৫৭টি প্রতিযোগিতায় ১৮টি সোনার পদক জিতেছিলেন হরিয়ানার এই টেনিস খেলোয়াড়।
তাঁর পরিচিত এবং আত্মীয়েরা জানিয়েছেন, অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন রাধিকা। কাঁধের চোট পাওয়ার জন্য খেলা থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছিলেন তিনি। তবে সম্প্রতি একটি টেনিস প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলেছিলেন। সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে টেনিস প্রশিক্ষণ দিতেন রাধিকা। খুব ভাল চলছিল সেই প্রশিক্ষণকেন্দ্র। রাধিকা নিজেও এ বিষয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। শুধু খেলা নিয়েই পড়ে থাকতেন, এমনটা নয়। সমান ভাবে বাড়ির কাজও সামলাতেন তিনি। যে মেয়ের উপর বাড়ির প্রতিটি সদস্যের এত ভরসা ছিল, তাঁর সাফল্যে আনন্দিত ছিল, সেই মেয়েই হঠাৎ করে তাঁর বাবার চক্ষুশূল হয়ে উঠলেন কেন? এখন সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।
রাধিকা খুনের পর নেপথ্যে অনেকগুলি তত্ত্ব ঘুরপাক খাওয়া শুরু করেছে।
ইনস্টাগ্রাম রিল
প্রাথমিক ভাবে খুনের নেপথ্যে যে তত্ত্বটি উঠে এসেছে, সেটি হল রাধিকার ইনস্টাগ্রামে রিল বানানো। এই বিষয়টি নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলেন না তাঁর বাবা দীপক। তিনি নাকি বার বার আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আপত্তি শোনেননি রাধিকা। তার পরই কন্যাকে দীপক গুলি করে খুন করেন বলে দাবি। পুলিশের একটি সূত্রের খবর, তদন্ত এগোতেই দেখা গিয়েছে, ইনস্টাগ্রাম রিল বানানো খুনের নেপথ্য কারণ নয়। তা হলে? তার পরে উঠে আসে আরও একটি তত্ত্ব। যদিও তদন্তকারীদের সন্দেহ, সেই তত্ত্বেরও কতটা সত্যতা রয়েছে সেই বিষয়টাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
টেনিস প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
পুলিশি জেরায় দীপক নিজে একটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও তাঁর সেই দাবির সত্যতা কতটা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তদন্তকারীরা। গুরুগ্রাম পুলিশ সূত্রে খবর, রাধিকার টেনিস প্রশিক্ষণকেন্দ্র নিয়ে খুব একটি খুশি ছিলেন না দীপক। তিনি চাইতেন যে, রাধিকা এই প্রশিক্ষণকেন্দ্র বন্ধ করে দিক। কিন্তু রাধিকা সেই পথে হাঁটেননি। তার মধ্যে প্রশিক্ষণকেন্দ্রও বেশ সফল ভাবে চলছিল।
পড়শি, আত্মীয়দের কটাক্ষ, ‘মেয়ের উপার্জনে খাচ্ছিস’
রাধিকার প্রশিক্ষণকেন্দ্র ভাল চলায় পড়শি এবং আত্মীয়দের কটাক্ষের মুখে পড়তে হচ্ছিল বলে দাবি করেছেন দীপক। তাঁরা কটাক্ষ করে তাঁকে বলতে শুরু করেন, ‘ভালই তো, বসে বসে মেয়ের উপার্জনের টাকায় খাচ্ছিস’। এই কটাক্ষ তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তার মধ্যে রাধিকাকে প্রশিক্ষণকেন্দ্র বন্ধ করার কথা বললেও তিনি শুনতে চাননি। সব মিলিয়ে গত ১৫ দিন ধরে অত্যন্ত মানসিক দোলাচলে ছিলেন বলে দাবি দীপকের। মেয়ের জন্য অপমান সহ্য করতে হচ্ছে বাইরের লোকের কাছে, সেটা মানতে পারেননি বলেও দাবি তাঁর।
কী হয়েছে জানি না
রাধিকার মা মঞ্জু যাদব মেয়ের খুনের বিষয়ে একটি কথাও বলেননি বলে পুলিশ সূত্রে খবর। শুধু দাবি করেছেন, ঘটনার সময় তিনি ছিলেন না। তাঁর জ্বর হয়েছিল।
‘সম্মানরক্ষার্থে’ খুন?
প্রাথমিক ভাবে এই তত্ত্বগুলি উঠে এলেও পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রশ্নও উঠে এসেছে। যে ব্যক্তি নিজের কন্যার সাফল্যে গর্ববোধ করতেন, শৈশব থেকেই তাঁকে নানা রকম ভাবে সব কিছুতে সমর্থন করতেন, কী এমন ঘটল যে রাধিকার বিরুদ্ধে এত আক্রোশ জন্মেছিল তাঁর। ইনস্টাগ্রাম রিল বানানোর বিষয়টি খুনের কারণ বলে মনে করছেন না তদন্তকারীদের একাংশ। আবার প্রশিক্ষণকেন্দ্র বন্ধ করা নিয়ে বাবা-মেয়ের ঝামেলাকেও এই চরম পদক্ষেপের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে না। যদি প্রশিক্ষণকেন্দ্র বন্ধ করার বিষয়টিই এর কারণ হত, তা হলে শুরু থেকেই কেন এর বিরোধিতা করেননি দীপক? দীর্ঘ দিন চলার পর কেন তা বন্ধ করার প্রসঙ্গ উঠল? তদন্তকারীদের একটি সূত্র বলছে, এটি ‘সম্মানরক্ষার্থে’ খুন কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা নাগাদ রাধিকাকে গুলি করে খুন করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বাবা দীপকের বিরুদ্ধে। রাধিকা তখন রান্নাঘরে ছিলেন। দীপক তাঁকে লক্ষ্য করে পাঁচ রাউন্ড গুলি চালান। তিনটি গুলি রাধিকার পিঠ, বুক ফুঁড়ে দেয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রাধিকার।