ম্যানুয়েলকে জড়িয়ে শিশুদের কান্না। নিজস্ব চিত্র।
ইচ্ছে ছিল দিন সাতেক অসমে থেকে, এখানকার গ্রাম্য জীবন দেখবেন।
কিন্তু ম্যানুয়েল আরিবাস রডরিগেস শেষ পর্যন্ত যখন ফেরার ট্রেন ধরলেন ততদিনে ক্যালেন্ডারে কেটে গিয়েছে সাত মাস!
অচেনা-অজানা অতিথি হয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে শিবসাগরের বকতা বকতিয়াল গ্রামে ঢোকা স্প্যানিশ যুবক গত সাত মাসে হয়ে উঠেছিল সকলের নয়নের মণি। কখনও চাষবাস করছেন, কখনও গিটার বাজিয়ে গান, কখনও বাচ্চাদের শেখাচ্ছেন স্প্যানিশ, কখনও ফলাচ্ছেন সবজি। কার্যত গত সাতটা মাসে সদানন্দ যুবকটিকে কখনও চুপ করে বসে থাকতে দেখেনি কেউ। অন্তরায় হয়নি ভাষার ব্যবধান। সকলকে কাছে টেনে নেওয়া ছেলেটা যে লকডাউনের পরে সত্যিই গ্রাম ছেড়ে নিজের দেশে রওনা হবেন- তা মানতে মন চাইছিল না কারও।
দেশ ভ্রমণের উদ্দেশে ম্যানুয়েল তাঁর সাইকেল নিয়ে গত বছর অগস্টে স্পেন থেকে বিমানে চাপেন জাপানের উদ্দেশে। জাপান থেকে কোরিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড, মায়ানমার হয়ে ২৭ জানুয়ারি ঢোকেন মণিপুরে। তখনও ‘লকডাউন’ অপরিচিত শব্দ।
ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে তিনি পৌঁছান শিবসাগর জেলায়। গড়গাঁও গ্রামে যুব উৎসবে তাঁর আলাপ হয় কলেজ ছাত্র বিশ্বজিৎ বরবরুয়ার সঙ্গে। ম্যানুয়েলকে সঙ্গে করে নিজের গ্রামে নিয়ে আসেন বিশ্বজিৎ। প্রথম দর্শনেই গ্রামের প্রেম পড়ে যান ম্যানুয়েল। অনুমতি চান হপ্তাখানেক কাটানোর। কিন্তু সকলের সঙ্গে এমনই মিলেমিশে যান যে মাস পেরিয়ে যায়। এ দিকে ততদিনে করোনার জেরে বন্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক উড়ান। শুরু হয় লকডাউন। আটকে পড়েন ম্যানুয়েল।
কিন্তু গ্রামের মানুষ তাঁকে একলা বোধ হতে দেননি। ম্যানুয়েল নিজেও মাঠে নেমে চাষবাষ, বাগানে সবজি ফলানো, ডোবায় মাছ ধরা, বাচ্চাদের পড়ানো, গান শেখানোয় মেতে ওঠেন। শুরু করেন স্প্যানিশ ক্লাসও। শিখে নেন অসমীয়া গান, নাচ, ভাষা।
বিদেশের অজ্ঞাত গ্রামে আটকে পড়া ছেলে কেমন আছে- তা নিয়ে বেজায় চিন্তায় ছিলেন স্পেনে ম্যানুয়েলের মা-বাবা। কিন্তু ভিডিয়ো কলের দৌলতে বরুয়া পরিবারে ছেলের যত্ন আর গ্রামে ছেলের খাতির দেখে নিশ্চিত হন তাঁরা।
ম্যানুয়েলের উৎসাহে গ্রামে তৈরি হয়েছে সাইকেল ক্লাব। নিজস্ব চিত্র।
সময় থেমে থাকে না। আন্তর্জাতিক বিমান চালু হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনবার ভিসার মেয়াদও বাড়িয়েছেন তিনি। তাই এবার ফিরতেই হবে। সেই কথা পাড়তেই গ্রামের আবালবৃদ্ধবণিতা পথ আটকান। আদরের ম্যানুয়েলকে ছাড়তে নারাজ তাঁরা। কিন্তু বিদায় নিশ্চিত জেনে সোমবার দিনভর গ্রামে ম্যানুয়েলকে ঘিরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়।
তাঁর দেশভ্রমণের সঙ্গী, ৩০ বছরের পুরনো সাইকেলটা স্মৃতি হিসেবে রেখে গেলেন গ্রামের বাচ্চাদের জন্যে। কারণ তাঁর উৎসাহে গ্রামেও যে সাইকেল ক্লাব তৈরি হয়ে গিয়েছে!
ম্যানুয়েল বলেন, “বাড়ি থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে আমার যে আরও একটা এতবড় একটা পরিবার অপেক্ষা করছিল তা করোনা ও লকডাউনে না হলে জানতেই পারতাম না।”
গত রাতে রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি রওনা হয়েছেন তিনি। ২৬ সেপ্টেম্বর আমস্টারডাম হয়ে স্পেন যাবেন।
বিদায়বেলায় চোখের জল থামছিল না কারও। ম্যানুয়েল আঙ্কলকে জড়িয়ে ধরে থাকে বাচ্চারা। কান্না ভেজা কচি গলাগুলো বলতে থাকে, ‘আদিওস, আদিওস। নস ভেমোস দে ন্যুয়েভো’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy