পশ্চিমবঙ্গে যা ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, বিহারে তা-ই ‘মহিলা রোজগার যোজনা’। ওড়িশায় সেটিই ‘সুভদ্রা যোজনা’। কর্নাটকে যা ‘গৃহলক্ষ্মী’, মধ্যপ্রদেশে সেটিই ‘লাডলি বহিন’। মহারাষ্ট্রে তারই নাম ‘লাড কি বহিন’।
রাজ্যভেদে নাম আলাদা। কিন্তু কাজ এক— মহিলাদের ‘ক্ষমতায়ন’! অর্থাৎ, মহিলাদের হাতে নগদ অর্থ দিয়ে তাঁদের ‘ক্ষমতাশালী’ করে তোলা। বর্তমানে দেশের মোট ১২টি রাজ্যে চালু আছে মহিলাদের আর্থিক অনুদান দেওয়ার সরকারি প্রকল্প। এক-একটি ভোট আসছে আর সেই অনুদানের পরিমাণ বাড়ছে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ১২টি রাজ্যে এই আর্থিক অনুদান বাবদে প্রদেয় অর্থের পরিমাণ ১,৬৮,০৫০ কোটি টাকা! যা গোটা দেশের জিডিপি-র ০.৫ শতাংশ। উল্লেখ্য, দু’বছর আগে এই খাতে অনুদানের পরিমাণ ছিল দেশের জিডিপি-র ০.২ শতাংশ।
মহিলা ভোটারদের মন পেতে পক্ষ-বিপক্ষ, বিজেপি, অ-বিজেপি সকলেই সমান সজাগ। শুক্রবার বেলা ১২টা নাগাদ বিহারের বিধানসভা ভোটে ভরাডুবি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরে কংগ্রেসের তরফে প্রথম বিবৃতি দেন বিহারের ভোটে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা তথা রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত। তাঁর কথায়, “বিহারের ফল হতাশাজনক, এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ভোটের প্রচার চলাকালীনও মহিলাদের ১,০০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। কমিশন সব দেখেও নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল।’’ কেন তা বন্ধ করা হয়নি, সেই প্রশ্ন তোলেন বটে কংগ্রেস নেতা। কিন্তু মহিলা ভোটারদের জন্য মহাগঠবন্ধনের ‘মুখ্যমন্ত্রী মুখ’ লালুপুত্র তেজস্বী যাদবও চেষ্টার কসুর করেননি। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ভোটে জিতলেই প্রত্যেক মহিলা বছরে ৩০ হাজার টাকা করে পাবেন। বিহারের মহিলারা নীতীশ কুমারের প্রকল্পে বেশি আস্থা দেখিয়েছেন। কারণ, তাঁরা টাকা পেয়েছেন ভোটের আগে। রাজ্যের শাসক হওয়ায় এই ধরনের অনুদান দেওয়া বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে যে সহজতর হয়, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্যএর বিভিন্ন উন্নয়নমূলক এবং পরিকাঠামোগত প্রকল্প যে অর্থাভাবে পড়ে, সে কথাও সত্য।
প্রধানমন্ত্রী মোদী নগদ টাকা দেওয়ার প্রকল্পকে অ-বিজেপি সরকারের ‘রেউড়ি (একপ্রকার মিষ্টি) রাজনীতি’ বলে কটাক্ষ করলেও বিহারের ভোটের আগে দিল্লি থেকে ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’ প্রকল্পের সূচনা করে ‘রেউড়ি’ তিনিও খাইয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী ঘোষণা করেছিলেন, ব্যবসা করে স্বনির্ভর হতে চান, এমন মহিলাদের ১০ হাজার টাকা করে এককালীন আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, অ্যাকাউন্টে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোও শুরু হয়ে গিয়েছে। বিহারে বিপর্যয়ের পরে কংগ্রেসনেতা গহলৌত সে কথাই উল্লেখ করেছেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিহার হোক বা বাংলা, অনুদানের রাজনীতি সর্বত্র ‘হিট।’ কিন্তু একইসঙ্গে এ-ও ঠিক যে, রাজ্যে রাজ্যে এমন অনুদানের রাজনীতি দেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলিকে ক্রমশ খাদের কিনারায় ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
মাসের শুরুতে হাতে এক হাজার-দু’-হাজার টাকা পাওয়ায় স্বভাবতই খুশি মহিলারা। গ্রামীণ ভারতের অনূঢ়া থেকে বধূ কিংবা প্রৌঢ়া মাস গেলে সংসারের জন্য কিছু ব্যয় করতে পারছেন, এ কম কথা নয়। কিন্তু সেই অনুদান দিতে গিয়ে সরকারের পিঠে ঋণের বোঝা ক্রমশ ভারী থেকে অতি ভারী হচ্ছে। তথ্য বলছে, অসম সরকার মহিলাদের অনুদান খাতে ৩১ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি করছে। পিছিয়ে নেই বাংলাও। চলতি অর্থবর্ষে তারা মহিলাদের জন্য আর্থিক অনুদান বৃদ্ধি করেছে ১৫ শতাংশ। ঝাড়খণ্ড সরকার গত অক্টোবর থেকে ‘মুখ্যমন্ত্রী মাইয়া সম্মান’ যোজনায় আর্থিক অনুদান হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা করেছে। হালে ওড়িশা সরকার কৃষকদের জন্যও নগদ অর্থসাহায্যের প্রকল্প ঘোষণা করেছে।
অর্থব্যয়ের মতো পরিস্থিতি না থাকায় অনুদানের পরিমাণ কমানোর নজিরও রয়েছে। যেমন, সম্প্রতি ‘লাড কি বহিন’ যোজনায় মাসিক বরাদ্দ ১৫০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা করে দিয়েছে মহারাষ্ট্র সরকার। কারণ, কৃষকদের জন্য একটি প্রকল্প এনেছে তারা। সেখানে মাসে মাসে হাজার টাকা করে পাচ্ছেন কৃষকেরা। ফলে ভাঁড়ারে টান পড়েছে।
আরও পড়ুন:
সেই সূত্রেই প্রশ্ন উঠছে, এতে কি অর্থনীতির ভাল হচ্ছে? শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য পরিকাঠামো খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করলে তাতে সার্বিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হতে পারত। অনুদানের ঠেলায় ধাক্কা খাচ্ছে সেই কাজগুলি। ইতিমধ্যে ভর্তুকি, কৃষিঋণ মকুব এবং নগদ অর্থ হস্তান্তরে ক্রমবর্ধমান ব্যয় সম্পর্কে বেশ কিছু রাজ্যকে সতর্ক করেছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)। একাধিক সমীক্ষা বলছে, ভোটারদের আর্থিক অনুদান দিচ্ছে, এমন ছ’টি রাজ্যে ২০২৫-’২৬ অর্থবর্ষে রাজস্ব ঘাটতি ব্যাপক পর্যায়ে পৌঁছবে। অনুদানের ‘ওষুধে’ চটজলদি ফল মিললেও ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া’ অবশ্যম্ভাবী।