E-Paper

গুলিতে মরে না ভাবনা, ছায়া-যুদ্ধ তাই চলছেই

ছত্তীসগঢ়ে পরপর ‘সংঘর্ষে’ প্রাণ যাচ্ছে মাওবাদীদের। কেন? স্থানীয়, আদিবাসীরা কি মুখ ফেরাচ্ছেন? মাওবাদীদের খাসতালুকে । সঙ্গী চিত্রগ্রাহক দেবরাজ ঘোষ।

কিংশুক গুপ্ত ও দেবরাজ ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫ ০৭:৪২
মাওবাদী দমনে ডিস্ট্রিক্ট রিজ়ার্ভ গার্ডের প্রহরা। দন্তেওয়াড়ার জঙ্গলে।

মাওবাদী দমনে ডিস্ট্রিক্ট রিজ়ার্ভ গার্ডের প্রহরা। দন্তেওয়াড়ার জঙ্গলে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

সকাল-সকাল খবর ভেসে আসে ছত্তীসগঢ়ের জঙ্গলে। অবুঝমাঢ় অঞ্চলে নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে ‘গুলির লড়াইয়ে’ নিহত ২৭ জন মাওবাদী। নিহত শীর্ষ নেতা নম্বলা কেশব রাও ওরফে বাসবরাজুও। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে খবর। ওয়াকিবহাল মহল জানে, মাওবাদী দমনের আখ্যানে এই মোড় হঠাৎ আসেনি। মাওবাদী ভাবনার শিকড় এখনও মজবুত জেনেই নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রণকৌশল সাজিয়েছিল পুলিশ। দু’বছর ধরে সেই অভিযানে ৪৫০ জন মাওবাদী প্রাণ হারিয়েছেন। গত ১৬ মাসে আত্মসমর্পণ করে মূল স্রোতে ফিরেছেন ১৪০০ জন।

কিন্তু মাওবাদী শীর্ষ নেতাকেখতম করলেও কি ভাবনার শিকড় উপড়ে ফেলতে পেরেছে ছত্তীসগঢ়ের পুলিশ? রাজ্যে মাওবাদী দমনে সাফল্যের জন্য চর্চায় যে দক্ষিণ ভারতীয় আইপিএস, সেই আইজি (বস্তার রেঞ্জ) সুন্দররাজ পট্টিলিঙ্গম ওরফে সুন্দররাজ পি নিজের দফতরে বসে জবাব দিলেন, ‘‘মাওবাদী দমন কেবল অস্ত্রের কাজ নয়, চলেছে সামাজিক ছায়াযুদ্ধও। পুলিশ এখন শুধু বাহিনী নয়, গ্রামবাসীর বন্ধু। স্থানীয় ভাষা জানা যুবক-যুবতীদের নিয়োগ করা হয়েছে বাহিনীতে। আদিবাসী ছেলেমেয়েরা ‘বস্তার ফাইটার্স’ ও ডিস্ট্রিক্ট রিজ়ার্ভ গার্ড-এর সদস্য। যার একাংশ মূলস্রোতে ফেরা প্রাক্তন মাওবাদী। ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে খেলাধুলোর সামগ্রী, চালু হয়েছে ‘বস্তার অলিম্পিক্স’,জনজাতি উৎসব।’’

তাতে কতটা কাজ হচ্ছে? গত কয়েক দিন ছত্তীসগঢ়ের মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা ঘুরে দেখার পর কিন্তু মালুম হচ্ছে কোনও কোনও এলাকায় ভয় ভাঙলেও, অনেক এলাকাতেই এখনও ভয়ের বাতাবরণ। উমরগাঁওয়ের প্রৌঢ়া ভগবতী নেতাম রাস্তার ধারে রোদে ভুট্টা দানা শুকোতে দেওয়ার ফাঁকে বলেছিলেন, ‘‘এক সময় ওরা (মাওবাদীরা) গ্রামের যাকে তাকে পুলিশের চর সন্দেহে খুন করত।

এখন পুলিশও ওদের খতম করছে। কিন্তু এতে স্থায়ী শান্তি কি ফিরবে?’’ মনের কথা বলতে পারেন না বা চান না অনেকেই। ভয় পুলিশকে, অদৃশ্য লাল-ছায়াকেও। নারায়ণপুরের আইনজীবী রোশন সাহু আবার বলছিলেন, ‘‘বন্দুক তো শেষ কথা বলে না। সমস্যার গভীরে গিয়ে পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। এলাকার মানুষ তো দু’নৌকার মাঝে রয়েছেন। এ ভাবে তো দীর্ঘ দিন থাকা যায় না।’’ যদিও সুন্দররাজের দাবি, “আমরা উন্নয়ন আর নিরাপত্তার যুগল নীতিতে চলেছি। মাওবাদীদের ‘রেড করিডর’ কার্যত শেষ। ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যাচ্ছে, মোবাইল নেটওয়ার্ক পাচ্ছে। এটা শুধু প্রশাসনিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক লড়াই।”

সেই লড়াইয়ের ছাপ কিন্তু এলাকা ঘুরলেই বোঝা য়ায়। গ্রামের পর গ্রামে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর শিবির। দন্তেওয়াড়া, বিজাপুর, নারায়ণপুরের মতো শহরগুলিতে জনজীবন স্বাভাবিক থাকলেও শহর ছাড়িয়ে পাহাড়-জঙ্গলের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে থমথমে পরিবেশ। কোরনপাল গ্রামের পথে সারের বস্তা নিয়ে যাওয়ার সময় লছমন হেমলা তো বলেই ফেললেন, ‘‘প্রাক্তন মাওবাদীরাও এখন পুলিশের সশস্ত্র বাহিনীতে। ফলে আশঙ্কা তো থেকেই যায়!’’ কিসের আশঙ্কা? জবাব দেন না কৃষক লছমন। কুতুলের রবি করঙ্গার মতো অনেকেই অবশ্য বলেই দেন, ‘‘ওরাও (মাওবাদী) কি চুপ করে বসে থাকবে। এখনও সব জায়গায় পুলিশের অবাধ গতিবিধি নেই। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সমস্যা সব চেয়ে বেশি। এক দিকে বাহিনী, অন্য দিকে নকশাল।’’

২০০৩ সালের আইপিএস ব্যাচের ছত্তীসগঢ় ক্যাডার সুন্দররাজ অবশ্য আত্মবিশ্বাসী। তাঁর স্পষ্ট দাবি, ‘‘বস্তার রেঞ্জে (যেখানে সাতটি জেলা— বস্তার, দান্তেওয়াড়া, বিজাপুর, সুকমা, নারায়ণপুর, কোন্ডাগাঁও ও কাঁকের রয়েছে) মাওবাদী আন্দোলন শেষ পর্বে।’’ তাঁর বাড়ি তামিলনাড়ুর কোয়ম্বত্তূরে। ২২ বছর ধরে মাওবাদী প্রভাবিত একাধিক জেলায় পুলিশ সুপারের দায়িত্ব সামলে প্রথমে দান্তেওয়াড়া রেঞ্জের ডিআইজি। এখন বস্তার রেঞ্জের আইজি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে হিসাব দেন, ‘‘গত ১৬ মাসে ১৪০০ মাওবাদী মূল স্রোতে ফিরেছে। ৪৬০ জন মারা গিয়েছে সংঘর্ষে। গত এক বছরে ২৭০ জন, আর এই বছর এখনও পর্যন্ত ১৯০।” বাসবরাজুর মৃত্যু কি সেই পালাবদলের বিরাট মোড়? কারণ, বাসবরাজু তো শুধু মাওবাদী অপারেশন কমান্ডার ছিলেন না, ছিলেন প্রত্যন্ত আদিবাসী এলাকায় মাওবাদী আন্দোলনের ‘মিথ’ও। পুলিশ মহলের দাবি, তাঁর মৃত্যুর অর্থ সেই ‘মিথ’ ভেঙে যাওয়া।

কিন্তু নেতার ছায়া, ভাবনা কি এত তাড়াতাড়ি মুছে যায়? তা হলে কেন একাধিক গ্রামে বাসিন্দারা নিজের নাম বলতে চান না, এমনকি গ্রামের প্রধানরাও নাম না বলে নীরব থাকেন? অভিজ্ঞ আইজি তা বিলক্ষণ জানেন। আর জানেন বলেই সবিস্তারে বলেন, বস্তার রেঞ্জে গড়ে উঠেছে প্রায় ৫০০ শিবির। লক্ষ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি এলাকাবাসীকে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দেওয়া, যাতে বঞ্চনার বাস্তব পিছনে ঠেলে দেওয়া যায়, যাতে বঞ্চনার পথ ধরে মাওবাদী উত্থান না ঘটে।

সুন্দররাজের কথায়, “আগে রাস্তা ছিল না, স্কুল ছিল না, হাসপাতালে যাওয়া মানে দিন নষ্ট। এখন পুলিশবাহিনীর উপস্থিতিতে পরিষেবা পৌঁছে যাচ্ছে।” তবে সতর্কও তিনি। ‘‘এখন মাওবাদীরা সংখ্যায় কমছে, প্রভাবও কমছে। তবে আমরাও নিরন্তর নজর রাখছি। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হচ্ছে।’’ মাওবাদীদের তরফে আলোচনার প্রস্তাব উপেক্ষা করা হচ্ছে কেন? সুন্দররাজের দাবি, “ওদের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ওরা সে সুযোগ নেয়নি। আমরা অযথা মানুষ মারতে চাই না। কিন্তু খুন-সন্ত্রাস করে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে চাইলে, ফল পেতেই হবে।”

বস্তার জেলা বিজেপির সভাপতি বেদপ্রকাশ পান্ডে অবশ্য মাওবাদীদের প্রত্যাবর্তন বা মাওবাদের প্রভাব নিয়ে সামান্য সতর্কতাও রাখতে চান না। বলছেন, ‘‘২০২৩-এ আমরা রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর চারিদিকে কেবল উন্নয়ন আর উন্নয়ন! বাহিনী যে ভাবে সাফল্য পাচ্ছে, কিছু দিনের মধ্যে মাওবাদ বলে আর কিছু থাকবে না।’’ প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দারা কিন্তু ত্রস্ত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দন্তেওয়াড়ার হিরোলি, আরানপুর, নিলাওয়া গ্রামের কয়েক জন বাসিন্দা বলেই দেন, গত দু’দশকে এলাকার শিশুদের মাওবাদের পাঠ দিয়েছে মাওবাদীরা। ফলে সমস্যার দ্রুত সমাধানের পথ দেখছেন না তাঁরা। বস্তার জেলা কংগ্রেসের নেতা মনোহর লুনিয়াও বলছেন, ‘‘মাওবাদী প্রভাব কমেছে। তবে শুধু অস্ত্র দিয়ে সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব নয়। উন্নয়নের পাশাপাশি, সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ সরকারকে খুঁজতে হবে।’’

আইজি-র অবশ্য দাবি, ‘‘আদর্শে নয়, অস্ত্র আর সন্ত্রাসের ভয়েই গ্রামের বাসিন্দারা মাওবাদীদের সমর্থন করতে বাধ্য হতেন। ছবিটা বদলাচ্ছে। মাওবাদী মুক্ত এলাকা এখনসময়ের অপেক্ষা!’’

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Maoists bastar

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy