ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসে পাকিস্তানকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বার্তা দিলেন বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী। গত কালের মতো আজও কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশ মন্ত্রকের তরফে তিনি বলেন, ‘‘ভারত যা করেছে তা প্রত্যাঘাত। পাকিস্তান আসল সন্ত্রাস শুরু করেছিল ২২ এপ্রিল পহেলগামে। ভারত শুধুমাত্র নিজেকে রক্ষার অধিকার প্রয়োগ করে যাচ্ছে।’’ পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘‘১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকে পাকিস্তান ক্রমাগত মিথ্যা বলে যাচ্ছে, এখনও সেই ধারাবাহিকতা তারা বজায় রাখছে ভারতের বিরুদ্ধে ভ্রান্ত প্রচার চালিয়ে।’’ মিস্রী আজ একটি ছবিও নিয়ে এসেছিলেন সাংবাদিক সম্মেলনে। সেখানে তিনি দেখান, ভারতীয় সামরিক অভিযানে নিহত তিন জঙ্গির শেষকৃত্যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন পাকিস্তানের এক সেনা। বিদেশসচিবের বক্তব্য, একমাত্র পাকিস্তানেই এটা সম্ভব! জঙ্গি কফিন পাকিস্তানের পতাকায় মুড়ে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হচ্ছে।
অন্য দিকে, আমেরিকার বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো আজ রাতে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে কথা বলেছেন ফোনে। অবিলম্বে সংঘাত কমানোয় জোর দিয়েছেন আমেরিকান কর্তা। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি কথা বলানোর জন্য আমেরিকা প্রস্তুত বলে জানান রুবিয়ো। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইয়ে আমেরিকা পাশে রয়েছে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, জি২০, জি৫ ভূক্ত রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে এবং পশ্চিম এশিয়া-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর কথা বলছেন ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে। আজ দিল্লিতে জয়শঙ্কর বৈঠক করেছেন সৌদির বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে। ইরানের বিদেশমন্ত্রীও ভারত-ইরান যৌথ কমিশনে যোগ দিতে নয়াদিল্লিতে এসে জয়শঙ্করের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রত্যেকের কাছেই এই বার্তা দিতে চাইছে দিল্লি, তা হল, ভারত প্রথমে আঘাত করেনি, করেছে পাকিস্তান। দ্বিতীয়ত, ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ একেবারেই সন্ত্রাস দমন অভিযান, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ অথবা সেনার বিরুদ্ধে কোনও হামলা করা হয়নি। এই বার্তাই বিশ্বকে দিচ্ছে মোদী সরকার যে গোটা বিষয়টি পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে ফিরিয়ে আনার অভিপ্রায় থেকে করা হয়নি, হয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে।
আজ মিস্রীর বক্তব্য, “আমাদের উদ্দেশ্য নয় পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করা। আমরা আমাদের বিরুদ্ধে হওয়া হামলার প্রত্যাঘাত করেছি মাত্র। আমাদের প্রত্যাঘাত ছিল সুনিয়ন্ত্রিত, নির্দিষ্ট নিশানায় এবং মাপা। কোনও সামরিক নিশানা ছিল না। শুধু মাত্র সন্ত্রাসবাদী শিবিরগুলিই ছিল লক্ষ্য। পাকিস্তান যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের স্নায়ুকেন্দ্র, তার বহু পাথুরে প্রমাণ রয়েছে। শুধু মাত্র ভারত নয়। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন সরকার এবং সংস্থার কাছেও সেই প্রমাণ রয়েছে। গোটা বিশ্বে এমন অনেক জঙ্গি হামলা হয়েছে যেখানে পাকিস্তানের হাতের ছাপ রয়েছে। আমার আলাদা করে বলে দিতে হবে না, ওসামা বিন লাদেনকে কোথায় পাওয়া গিয়েছিল এবং তারা তাকে শহিদ বলেছিল!”
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রীও মিথ্য প্রচারে নেমে পড়েছেন বলে মনে করছে নয়াদিল্লি। এই প্রসঙ্গে বিদেশসচিব বলেছেন, “এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এ এমন দেশ যারা ১৯৪৭ সালে জন্ম নেওয়ার পর থেকেই মিথ্যা বলতে শুরু করেছে! এরা রাষ্ট্রপুঞ্জকেও মিথ্যা বলে!”
অন্য দিকে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছাড়াই নয়াদিল্লিতে এসেছেন সৌদি আরবের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী আদেল আল-জ়ুবের। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকও করলেন তিনি। যুদ্ধের আবহে আদেলের সফরকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। তাঁদের মতে, নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যেই আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুরাষ্ট্র সৌদির মন্ত্রীর এই হঠাৎ সফর। সৌদি বিদেশ দফতরের তরফে একটি এক্স পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘‘ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন আদেল। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনমনীয় ভাবে লড়াই করার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে।’’
ভারতীয় সেনার অভিযান ঘিরে নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ সংঘাতের আবহে বুধবার গভীর রাতে ভারতে এসেছেন ইরানের বিদেশমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি। তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, “ভারত যুদ্ধ চায় না। কিন্তু হামলা হলে অত্যন্ত কঠোর জবাব দেবে ভারতীয় সেনা।” বৃহস্পতিবার ভারত– ইরান যৌথ কমিশনের বৈঠকে জয়শঙ্কর বলেন, “আপনি এমন সময় ভারতে এসেছেন, যখন ভারত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরে হওয়া বর্বর জঙ্গি হামলার জবাব দিচ্ছে। এই হামলার ফলে গত ৭ মে সীমান্তের ওপারে জঙ্গি ঠিকানায় হামলা চালাতে আমরা বাধ্য হয়েছি। আমাদের প্রতিক্রিয়া সুনির্দিষ্ট ও পরিমিত। আমাদের পরিস্থিতি খারাপের দিকে নিয়ে যাওয়ার কোনও ইচ্ছা নেই। কিন্তু আমাদের ওপর সামরিক হামলা হলে সন্দেহাতীত ভাবে আমরা তার অত্যন্ত কঠোর জবাব দেব। একজন প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে গোটা পরিস্থিতির নিয়ে আপনার স্বচ্ছ্ব বোধগম্যতা একান্ত জরুরি।” ইরানের বিদেশমন্ত্রী বলেন, ‘‘ভারত ও ইরানের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থরক্ষার ভিত্তিতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপভোগ করে চলেছি। আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কও ভাল। তবে নিষেধাজ্ঞার জন্য যতটা ভাল হতে পারত, ঠিক ততটা নয়। আশা করি ভবিষ্যতে আমরা সেই প্রতিকূলতাও কাটিয়ে উঠতে পারব।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)