Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সমঝোতা কবে, তিন দিন স্টেশনেই কাটালেন নসিমা-ওয়াসিম

ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপড়েন, সীমান্তে উত্তেজনা, রাষ্ট্রনেতাদের রক্তচক্ষু পেরিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁদের যখন দেখা হয়েছিল, তখন কুড়িটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে।

ফেরা: দিল্লিতে পা রেখে স্বস্তি নসিমা-ওয়াসিমের। নিজস্ব চিত্র

ফেরা: দিল্লিতে পা রেখে স্বস্তি নসিমা-ওয়াসিমের। নিজস্ব চিত্র

অনমিত্র সেনগুপ্ত
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ০৩:৪৮
Share: Save:

সীমান্তের কাঁটাতারে বিচ্ছিন্ন দু’বোন। এক জন লাহৌরের বাসিন্দা, অপর জন দিল্লির।

ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপড়েন, সীমান্তে উত্তেজনা, রাষ্ট্রনেতাদের রক্তচক্ষু পেরিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁদের যখন দেখা হয়েছিল, তখন কুড়িটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু দুই বোনের পুনর্মিলনে বাধ সাধল পুলওয়ামা-বালাকোট!

সম্প্রতি দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনা নিয়ে প্রথম দিকে মাথা ঘামাননি বছর পঁয়তাল্লিশের নসিমা এবং তাঁর ছেলে ওয়াসিম। দিল্লির ওখলা এলাকার বাসিন্দা মা-ছেলে গত ফেব্রুয়ারিতে সীমান্ত পেরিয়ে প্রথমবার পৌঁছেছিলেন লাহৌরে। নসিমার বোন নফিসার শ্বশুরবাড়ি গুনটি বাজারে। কুড়ি বছর আগে বিয়ের সময় শেষবার বোনকে দেখেছিলেন নসিমা। এ বারের লাহৌর-যাত্রা সেই বোনের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে। বোনের শ্বশুর বাড়িতে প্রথম যাওয়া। মেহমান এসেছে সীমান্ত পেরিয়ে—খামতি ছিল না মেহমান নওয়াজির। ভিসা এক মাসের জন্য হলেও লাহোরি চিকেন, বিরিয়ানি, লাহোরি ডাল মুর্গের স্বাদ আর ওয়াসিমের পাকিস্তান ঘুরে দেখার ইচ্ছে—ভিসার মেয়াদ আরও এক মাস বাড়িয়েছিলেন নসিমারা। ঠিক হয়েছিল, এ যাত্রায় অনুষ্ঠান বাড়িতে আরও ক’দিন কাটিয়ে আসবেন।

মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক! নসিমাদের ইচ্ছে ভেস্তে দিল বালাকোট!

ওয়াসিমের কথায়, ‘‘বালাকোটে হামলা হতেই বুঝলাম পরিস্থিতি গোলমেলে। তাড়াতাড়ি বাড়ির ফেরার জন্য দিল্লি থেকে বাবা ফোন করেন। টিকিট কাটা হয় গত বৃহস্পতিবার। তার পর থেকেই ভোগান্তির শুরু।’’ সমঝোতা এক্সপ্রেস দিল্লি থেকে বুধবার ও রবিবার ছাড়ে। সেই ট্রেন পাকিস্তান পৌঁছলে বৃহস্পতিবার ও সোমবার তা ছাড়ে লাহৌর থেকে। কিন্তু গত মঙ্গলবার ভারত বালাকোটে হামলা চালাতেই বাতিল হয় সমঝোতা এক্সপ্রেস। ফলে বৃহস্পতিবার স্টেশন থেকে ঘুরে যেতে হয় নসিমাদের। ফের ট্রেনের খোঁজে শুক্রবার স্টেশনে গিয়েছিলেন মা ও ছেলে।

নসিমারা যখন দেশে ফেরার জন্য তৎপর, তখন নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমশ বাড়ছে। ওই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে থাকার ঝুঁকি নেননি নসিমেরা। পাছে সমঝোতা এক্সপ্রেস চলে যায়, তাই বোনের অনুরোধ উপেক্ষা করে নসিমা এবং ওয়াসিম স্টেশনেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঠিকানা স্টেশনে ওয়েটিং রুম। ট্রেনের খোঁজে দফায় দফায় দরবার করেছেন স্টেশন মাস্টারের কাছে। শুনতে হয়েছে, ‘‘আপনাদের মোদী সরকার ট্রেন না পাঠালে কী করে ভারতে ফেরৎ পাঠাব?’’

স্টেশনের ওয়েটিং রুমে তিন দিন আধ জাগা-আধ পেটা খেয়ে কাটিয়েছেন মা-ছেলে। অবশেষে গতকাল, সোমবার প্রতীক্ষার অবসান। লাহৌর থেকে সমঝোতা এক্সপ্রেসে উঠে বসেন নসিমার মতো কয়েকশো যাত্রী। নসিমার কথায়, ‘‘প্রায় চার দিন ট্রেন না থাকায় ভিড়ও খুব হয়েছিল। সকলেই চাইছিলেন নতুন করে ঝামেলা হওয়ার আগেই দেশে ফিরতে।’’ কিন্তু দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনার পরিস্থিতিতে ভারতের বাসিন্দা বলেই নসিমেরা ফিরতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘‘ট্রেনের যাত্রীদের অধিকাংশ ভারতের বাসিন্দা। তাঁদের একটা বড় অংশই নেমে গিয়েছেন আটারিতে। দিল্লিতে নেমেছেন সামান্য কিছু পরিবার।’’

লাহৌর-যাত্রার পর নাসিমার উপলব্ধি, দু’দেশের মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই। তবু নিজের দেশ, নিজের দেশই। স্নাতক স্তরের ছাত্র ওয়াসিমেরও পাকিস্তানকে তেমন কিছু লাগেনি। ভবিষ্যতে বোনের শ্বশুরবাড়ির দেশে যেতেও আগ্রহী নন নসিমা। তবে তিনি চান তাঁর বোনকে ভিসা দিক ভারত। যাতে নিজের জন্মভূমিতে পা রাখতে পারে নফিসা।

নসিমাদের মতো যাদের দু’দেশেই আত্মীয় ছড়িয়ে রয়েছে, তাঁদের অনেকেরই অভিযোগ, পাকিস্তান যাওয়া তুলনায় সোজা। ভিসা পাওয়া যায় অনায়াসে। তুলনায় পাকিস্তান থেকে যাঁরা ভারতে আসতে চান, তাঁদের ভিসা পাওয়া বেশ কঠিন। ব্যতিক্রম অবশ্য অসুস্থদের ক্ষেত্রে। যদিও মোদী সরকারের প্রথম দিকে একাধিক পাক নাগরিক চিকিৎসার জন্য ভারতে এলেও, তাঁদের পরবর্তী পর্যায়ের চিকিৎসার সময়ে ভিসা পাওয়ায় নানবিধ সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, নিরাপত্তার কারণেই
ওই কড়াকড়ি।

নসিমাদের অবশ্য সে সব ঝামেলা পোহাতে হয়নি। সমঝোতা এক্সপ্রেস আজ পুরনো দিল্লি স্টেশন ছুঁয়েছে সাড়ে সাত ঘণ্টা দেরিতে। তবুও তাঁদের চোখে-মুখে স্বস্তির ছাপ। শেষ পর্যন্ত ঘরের মাটিতে পা পড়ল যে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Samjhauta express DElhi Pakistan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE