বেনজির সামরিক সমঝোতার পথে ভারত-চিন। বঙ্গোপসাগরে নৌ-মহড়া শেষ হওয়ার আগেই লাদাখের সীমান্তে যৌথ মহড়া দিল ভারত ও চিনের সশস্ত্র বাহিনী। দু’দেশের সম্পর্কের ইতিহাসে এই প্রথম বার লাদাখ সীমান্তে দ্বিপাক্ষিক মহড়া দিতে দেখা গেল ভারত ও চিনকে।
ভারত ও চিনের সশস্ত্র বাহিনী শনিবার লাদাখের চুসুল-মোল্ডো এলাকায় যৌথ মহড়া দিয়েছে। এই প্রথম লাদাখে লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল-এ ভারত ও চিনের বাহিনী জয়েন্ট ট্যাকটিকাল এক্সারসাইজ আয়োজন করল। ভারতের তরফে কর্নেল রীতেশচন্দ্র সিংহ এবং চিনের তরফে কর্নেল কিউ য়ি-এর নেতৃত্বে ৩০ জন করে সেনা মহড়ায় অংশ নেয়। সীমান্তবর্তী এলাকায় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে দু’দেশের বাহিনী হাত মিলিয়ে কীভাবে বিপর্যয়ের মোকাবিলা করবে, মহড়া দেওয়া হয়েছে তা নিয়েই। ভারত ও চিনের বাহিনীর মধ্যে চিরকাল উত্তেজনা দেখতে অভ্যস্ত লাদাখের জন্য চিন-ভারত যৌথ মহড়া সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা। ‘সিনো-ইন্ডিয়া কোঅপারেশন ২০১৬’ নামে যে নতুন কর্মসূচি ভারত ও চিন যৌথভাবে শুরু করেছে, তার অঙ্গ হিসেবেই লাদাখে ভারত ও চিনের সামরিক বাহিনীর এই যৌথ মহড়া বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় সম্প্রতি সিকিম সীমান্তেও যৌথ মহড়া দিয়েছে ভারত ও চিনের সশস্ত্র বাহিনী।
চলছে যৌথ মহড়া।
লাদাখ সীমান্তে মোতায়েন ভারতীয় বাহিনী ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি) এবং চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) মধ্যে সুসম্পর্ক নিকট অতীতে দেখা যায়নি। বরং সারা বছরই আইটিবিপি এবং পিএলএ-র মধ্যে ছোটখাটো গোলমাল লেগে থাকত। কখনও সীমান্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে পিএলএ-কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ত আইটিবিপি। কখনও ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সেই একই অভিযোগ আনত পিএলএ। তবে লাদাখে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) নামে পরিচিত দু’দেশের সীমান্ত চিনই বার বার লঙ্ঘন করে বলে ভারতের দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ২০১৫-র ১২ সেপ্টেম্বর সেই গোলমাল সবচেয়ে বড় আকার নেয়। লাদাখে বিতর্কিত এলাকায় চিনা সেনা ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করতে শুরু করলে গোলাবর্ষণ করে তা ভেঙে দেয় ভারতের আইটিবিপি। তার পর থেকে লাদাখের সীমান্তে আর কোনও সামরিক উত্তেজনার খবর নেই। বরং দুদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সমঝোতা বাড়াতে একের পর এক যৌথ মহড়ার পরিকল্পনা তৈরি করেছে নয়াদিল্লি ও বেজিং।
চলছে মহড়া।
ভারতকে সব দিক দিয়ে ঘিরতে চিন গত এক দশক ধরেই সক্রিয়। পাকিস্তানের গোয়াদর, শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা এবং বাংলাদেশের সোনাদিয়াতে বন্দর তৈরি করে ভারতের সব দিকে নিজেদের নৌসেনার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে চিন। দেরিতে হলেও, ভারতও চিনকে নৌসেনা দিয়ে ঘিরে ফেলার পাল্টা কৌশলে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। শ্রীলঙ্কার বন্দরে এখন মাঝেমধ্যেই ঘাঁটি গাড়ছে ভারতীয় নৌসেনার যুদ্ধজাহাজ। ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স আর ব্রুনেই-এর সঙ্গে সামরিক চুক্তির সুবাদে দক্ষিণ চিন সাগরকে সব দিক দিয়ে ঘিরে ফেলার ছক সাজিয়ে নিয়েছে ভারতীয় নৌসেনাও। কিন্তু পরস্পরকে ঘিরে ফেলার সেই প্রতিযোগিতা আপাতাত সরিয়ে রেখে এখন দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির চেষ্টাই চোখে পড়ছে। বঙ্গোপসাগরের বুকে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ফ্লিট রিভিউতে এক প্রতিবেশী পাকিস্তানকে নিমন্ত্রণ না করলেও, চিনকে ডেকেছিল ভারত। নয়াদিল্লির ডাকে সাড়া দিয়ে ভারত আয়োজিত এই মহড়াতে নিজেদের যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে দিয়েছে বেজিং। আমেরিকা, জাপানের মতো যে সব দেশের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক যথেষ্ট তিক্ত, সেই দেশগুলি এই মহড়ায় অংশ নিচ্ছে বলে জানা সত্ত্বেও ভারতের নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করেনি চিন। তার মধ্যেই শনিবার লাদাখে যৌথ মহড়া দিলেন ভারত ও চিনের সীমান্তরক্ষীরা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদরা বলছেন, বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণের কথা মাথায় রেখেই ভারতের সঙ্গে নৈকট্য বাড়াচ্ছে চিন। ভারত মহাসাগর, চিন সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরে ক্রমশ প্রভাব বাড়াতে থাকা ভারতের সঙ্গে তিক্ততার বদলে মৈত্রীই যে বেশি সুবিধাজনক, বেজিং সে কথা বুঝতে শুরু করেছে।
—নিজস্ব চিত্র।
এই সংক্রান্ত আরও খবর...