Advertisement
E-Paper

জম্মুর আকাশে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল বল, বিয়ের রোশনাই নাকি? সম্বিত ফিরল হ্যাঁচকা টানে, ওগুলো সব মিসাইল!

একেই কি যুদ্ধক্ষেত্র বলে? এই ভাবনা ভাবার সময় নেই। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের আওয়াজ আসছে খানিকটা দূর থেকে। শাটারের বাইরে তখনও মানুষ দৌড়চ্ছেন। তাঁদের পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

Indo-Pakistan conflict: first-hand Experience at the ground zero of Rajouri sector in Jammu & Kashmir

বৃহস্পতিবার রাতে জম্মুর আকাশে মালার মতো উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল বল। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

স্যমন্তক ঘোষ, রজৌরি (জম্মু)

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৫ ১৮:৫৭
Share
Save

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টা। জম্মু স্টেশন মোড়ে অটোওয়ালার সঙ্গে দর হাঁকাহাঁকি করছিলাম। আচমকা শব্দ ভেসে এল! দুম...দুম...দুম...!

আমি আর অটোচালক দু’জনেই চমকে উপরে তাকালাম। মাথার উপরে আকাশে মালার মতো উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল বল। তার পরে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে। দিল্লি থেকে জম্মু পর্যন্ত আসতে আসতে ১১ ঘণ্টার রাস্তায় সেনা কনভয় দেখেছি ঠিকই। তার সঙ্গে নজরে পড়েছিল কিছু উত্তর ভারতীয় বিয়েবাড়ির তাঁবুও। তা হলে কি বৃহস্পতিবার বিয়ে-টিয়ে আছে শহরে? এ কি সেই উৎসবের আতশবাজির রোশনাই!

সম্বিত ফিরল কলার ধরে হ্যাঁচকা টানে। অটোওয়ালা টেনে আমায় ঢুকিয়ে নিয়েছেন তাঁর বাহনের আপাত-নিরাপদ ক্যানভাসের খাঁচায়। হু-হু করে অটো ছুটতে শুরু করল। নিমেষের মধ্যে অন্ধকার নেমে এল গোটা শহর জুড়ে।

অটো থেকেই দেখছিলাম, যে যে দিকে পারছেন দৌড়চ্ছেন। ঝপঝপ করে শাটার নামছে দোকানের। একটা দোকানের সামনে ব্রেক কষে অটো থামিয়ে প্রায় ঠেলেই আমায় ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন অটোওয়ালা। ঢুকে পড়লেন নিজেও। সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশে দোকানের ঝাঁপ নেমে গেল। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইলের আলো জ্বেলে ফিস ফিস করে দোকানদার সম্ভবত স্ত্রীকে বলছিলেন, ‘‘আমি আমার সময়মতো চলে আসব। ঘরের আলো বন্ধ করে রাখো। সদর দরজার কাছাকাছি থেকো। দরকারে যেন এক দৌড়ে বাইরে বেরোতে পারো!’’ জানিয়ে রাখলেন, তিনি বাড়ি না-ফিরলেও চিন্তা নেই। তিনি নিরাপদেই থাকবেন। আমার মোবাইলে ঝপাঝপ টেক্সট মেসেজ আর হোয়াট্‌সঅ্যাপ ঢুকছিল— জম্মু এয়ারবেস আন্ডার অ্যাটাক!

দিল্লি থেকে জম্মুর বিমান বন্ধ। ভরসা একমাত্র ট্রেন বা গাড়ি। যুদ্ধক্ষেত্রে চেনা রথ আর পরিচিত সারথি সব সময় অতিরিক্ত সাহস জোগায়। সেই সাহসে ভর করেই ১১ ঘণ্টার রাস্তা উজিয়ে জম্মুতে ঢুকেছি খানিক আগে। তার সঙ্গে এই জম্মুর কোনও সম্পর্ক ছিল না। স্টেশনচত্বরে ভিড়। পানীয়ের দোকানের বাইরে চাট বিকোচ্ছে। উল্টো দিকে ফলওয়ালার দোকানে বাজছে অনুপ জালোটার ভজন। ব্র্যান্ডেড দোকানের ফ্যাক্টরি আউটলেটে জামা-জুতো কেনার ভিড়। যেমন শহরে হয়ে থাকে। খুব স্বাভাবিক। হোটেলে খানিক বিস্ময়ের সুরেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘শুনলাম গোলাগুলি চলছে?’’ সহাস্য জবাব এসেছিল, ‘‘সে তো ২০০ কিলোমিটার দূরে! পুঞ্চ সেক্টরে।’’

রাতটা কাটিয়ে আমার তো শুক্রবার পুঞ্চ আর রজৌরি যাওয়ারই কথা। অনেকটা পথ। সাড়ে ৮টা নাগাদ ব্যাগ দুলিয়ে বেরিয়েছিলাম গাড়িতে নেওয়ার জন্য শুকনো খাবারের খোঁজে। স্টেশন মোড়ে অটোওয়ালার সঙ্গে যখন দরাদরি করছি, তখনই ওই শব্দ আর আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল বল। পরে জানলাম, ওগুলো ছিল সেনার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র। মিসাইল!

এটাই কি যুদ্ধক্ষেত্র? সে ভাবনা ভাবারও সময় তখন ছিল না। নাগাড়ে বিস্ফোরণের আওয়াজ আসছে খানিকটা দূর থেকে। বন্ধ শাটারের বাইরে তখনও মানুষ দৌড়চ্ছেন। তাঁদের পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দোকানদার আর অটোওয়ালা বলাবলি করছেন, জম্মুতেও এ দৃশ্য দেখতে হবে ভাবতে পারেননি! গোলার আওয়াজ, গুলির আওয়াজ ছাপিয়ে তারস্বরে বেজে চলেছে সাইরেন।

প্রায় ৪০ মিনিট কাটল। ধীরে ধীরে আওয়াজ বন্ধ হল। আলো জ্বলল না। তবে শাটার উঠল দোকানের। বাইরে পিন-পতন নৈঃশব্দ্য। দূরে দূরে কোথাও মানুষ দেখা যাচ্ছে না। গোটা শহর অন্ধকার। তিরের মতো অটো নিয়ে পৌঁছোলাম হোটেলে। দেখলাম, সমস্ত অতিথিকে তত ক্ষণে নীচের লবিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। তাঁদের ‘ব্রিফ’ করছে পুলিশ। বলছে, সারা রাত আলো না-ও থাকতে পারে। প্রয়োজনে সকলকে গিয়ে ঢুকতে হবে বেসমেন্ট পার্কিংয়ে। গোটা রাত সেখানে থাকতে হতে পারে। পরের নির্দেশ না-আসা পর্যন্ত এটাই নির্দেশ। ‘ব্রিফিং’ শেষ হতে না-হতেই আবার গোলাগুলির শব্দ। বিস্ফোরণ। পুলিশ অবশ্য বলছিল, ‘‘ভয় নেই। প্রাথমিক বিপদ কেটে গিয়েছে। এখন যে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, তা ২০ কিলোমিটার দূরের সীমান্তে।’’

বৃহস্পতিবার রাতটা ওই ভাবেই কেটে গেল। প্রায় ভোররাতে আলো ফিরল। মিলল নিজের ঘরে যাওয়ার অনুমতি।

শুক্রবার এসেছি রাজৌরি-পুঞ্চ। আলো ফোটার আগে বেরিয়েছিলাম। গাড়ির হেডলাইট বন্ধ রেখে এগোনো শুরু। রাস্তার মধ্যে পর পর সেনা ব্যারিকেড। টর্চের জোরালো আলো পড়ছে গাড়ির ভিতরে। ছাড় পেয়ে গাড়ি এগোচ্ছে। চলতে চলতে যখন আমরা আখনুর সীমান্তের কাছাকাছি, ভোরের শেষ দফার গোলাগুলি আকাশ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। বাকি রাস্তায় সেনা কনভয় আর অ্যাম্বুল্যান্সের হুটারের আওয়াজ ছাড়া আর কিছু বলা-শোনার মধ্যে ছিল না।

পুঞ্চের ৪০ কিলোমিটার আগেই পুলিশের ব্যারিকেড। উপরে ওঠার অনুমতি নেই। একের পর এক অ্যাম্বুল্যান্স দ্রুতগতিতে নেমে আসছে। একের পর এক সেনা কনভয় উঠছে উপরে। গ্রামের মানুষবোঝাই একের পর এক বাস নেমে যাচ্ছে নীচে। যে সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলাম, তার নীচে পাথরগলা জল টুকটুকে লাল। সেতুর ডান দিকের পাহাড়ে যদি হয় পুঞ্চ, বাঁ-দিকের পাহাড়ে তা হলে কী? ছোট ছোট ব্যাগ হাতে ছেলেমেয়েদের হাত ধরে গোটা পরিবার নিয়ে যে গাদা গাদা মানুষ পায়ে হেঁটে নেমে আসছেন, তাঁরা কারা?

কাছে যেতে তাঁদের ইতস্তত মুখ আরও ইতস্তত হল! কেউ মুখ ঢাকলেন ওড়নায়, কেউ হাঁটা দিলেন আরও জোরে। পকেট থেকে লজেন্স বার করলাম। গুটিকয়েক বাচ্চা কাছে এসে দাঁড়াল। শুরু হল কথা। রজৌরি সেক্টরের গ্রামের মানুষও একই রকম অসহায়। গত রাতের গোলায় ভেঙেছে তাঁদেরও বাড়ি। এক কাপড়ে তাঁরা নেমে যাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ যাচ্ছেন পারিবারিক বন্ধুর বাড়ি, কেউ জানেন না কোথায় যাবেন! তবে ঠিক করে নিয়েছেন, রাতের গোলাগুলির মধ্যে আর থাকা যাবে না। গ্রামের পর গ্রাম কার্যত ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। পড়ে আছে গোলার আঘাতে আধভাঙা কিছু কাঠামো। এক রাত আগেও যে কাঠামোয় ভাত রান্না হত, বাচ্চারা খেলত ঘরের উঠোনে, সেই বাড়ির উঠোনে কড়াইয়ের মতো গর্ত এখন!

শুধু গ্রাম? রাজৌরি টাউনের গুটিকয়েক হোটেলে ছোট ছোট দোকানের পরিযায়ী শ্রমিকেরাও লোটাকম্বল গুছিয়ে ফেলেছেন। রাস্তা খোলা পেলেই ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। বহু দূরে থাকা পরিবার ঘুমহীন রাত কাটাচ্ছে। এলাকায় মানুষ কমছে, বাড়ছে সেনা। তীব্রতর হচ্ছে গোলাবারুদের শব্দ।

আনন্দবাজার ডট কম-এর জন্য এই লেখা যখন লিখছি, তখন সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। সাইরেন বাজতে শুরু করেছে। এ বার ‘ব্ল্যাকআউট’। সারা রাতের উৎকণ্ঠা নিয়ে জেগে থাকার ‘অ্যালার্ম ক্লক’ আবার চালু হল!

(লেখক ডয়চেভেলের সাংবাদিক)

India-Paksitan Conflict India-Pakistan relation Kashmir Terror Attack Pahalgam Terror Attack

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}