Advertisement
E-Paper

স্ত্রী এত মিথ্যুক ভাবেননি টিভি-কর্তা

এত বড় ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না স্টার ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সিইও পিটার মুখোপাধ্যায়। যাঁদের শ্যালক ও শ্যালিকা বলে জানতেন, তাঁরা যে আদতে স্ত্রী-র নিজের পুত্র-কন্যা সেটা জানতে পারলেন বিয়ের ১৩ বছর পর। এবং সেটাও এমন একটা পরিস্থিতিতে, যখন সেই কন্যা শিনা বরা-কে হত্যা করেছেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন মা ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়। মঙ্গলবারই মুম্বই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল ইন্দ্রাণীকে। গোড়ায় পুলিশ নিজেও জানত না যে, শিনা আসলে ইন্দ্রাণীর মেয়ে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৫০
ধৃত ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়। ছবি: টুইটার।

ধৃত ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়। ছবি: টুইটার।

এত বড় ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না স্টার ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সিইও পিটার মুখোপাধ্যায়। যাঁদের শ্যালক ও শ্যালিকা বলে জানতেন, তাঁরা যে আদতে স্ত্রী-র নিজের পুত্র-কন্যা সেটা জানতে পারলেন বিয়ের ১৩ বছর পর। এবং সেটাও এমন একটা পরিস্থিতিতে, যখন সেই কন্যা শিনা বরা-কে হত্যা করেছেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন মা ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়। মঙ্গলবারই মুম্বই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল ইন্দ্রাণীকে। গোড়ায় পুলিশ নিজেও জানত না যে, শিনা আসলে ইন্দ্রাণীর মেয়ে।

তবে পরিবারের ঘনিষ্ঠ কিছু সূত্র নাম গোপন করে আগের দিনই মুখ খুলেছিলেন সংবাদমাধ্যমে। বুধবার নিহত শিনার ভাই মিখাইল সরাসরি বোমাটা ফাটালেন। শিনাকে নিজের সহোদর বোন এবং নিজেকে ইন্দ্রাণীর পুত্র বলে দাবি করাই শুধু নয়। গুয়াহাটিতে বসে মিখাইল প্রকাশ্যে এটাও বললেন যে, মা-ই মেরেছে শিনাকে! বললেন, ‘‘মা পারে না এমন কাজ নেই। পুলিশের কাছে নিজের মুখে হত্যার কথা স্বীকার করলে ভাল! না হলে আমার হাতে যা তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, তা পুলিশের হাতে তুলে দেব।’’ জানা গিয়েছে, শিনা এবং মিখাইলের বাবার নাম সিদ্ধার্থ দাস। তিনি কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। তবে শিনা-হত্যা মামলায় এ দিন কলকাতা থেকে গ্রেফতার হয়েছেন ইন্দ্রাণীর আর এক প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব খন্নাও।

২০১২ সালে শিনা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে ইন্দ্রাণীর বর্তমান স্বামী পিটার মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণীর বাবা উপেন্দ্রকুমার বরা, মা দুর্গারানি বরা এবং পুত্র (যাঁকে পিটারের কাছে ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী) মিখাইল সকলে জানতেন— শিনা আমেরিকায় লেখাপড়া করছেন। এমনকী শিনার ভুয়ো ফেসবুক প্রোফাইল তৈরি করে ইন্দ্রাণীদেবী মাঝেমধ্যে নানা রকম ছবি দেখাতেন পিটারকে। শিনা আমেরিকার বিভিন্ন শহরে সময় কাটাচ্ছেন, দিওয়ালি পালন করছেন, এমন সব ছবিও সেখানে ছিল।

পিটার এ দিন সাংবাদিকদের জানান, তাঁর আগের পক্ষের ছোট ছেলে রাহুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শিনার প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তাই নিয়ে পরিবারে অশান্তিও হয়েছিল। তখন ইন্দ্রাণী দাবি করেছিলেন যে তাঁর ‘বোনের’ সঙ্গে রাহুলের সম্পর্ক তিনি মেনে নেবেন না। সেই জন্যই শিনাকে তিনি আমেরিকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। অশান্তি এড়াতে তা মেনে নেন পিটার। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, বিগত তিন বছরে শিনার সঙ্গে তাঁর কোনও দিন কথা হয়নি। শিনার ফোন নম্বরও তাঁর কাছে ছিল না। শুধু ফেসবুকে ছবি দেখেই তিনি কী করে শিনা সম্পর্কে এত নিশ্চিন্ত হয়ে রইলেন, সে প্রশ্ন ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের।

পিটারের নিজেরই কথায়, ছেলে রাহুল অনেক বার তাঁকে বলেছিলেন যে, শিনা ইন্দ্রাণীরই মেয়ে। এমনকী শিনা উধাও হয়ে যাওয়ার পরেও বাবাকে বলেছিলেন যে, এর মধ্যে রহস্য রয়েছে। কিন্তু পিটার স্বীকার করছেন, ছেলের কথা তিনি বিশ্বাস করেননি। এবং সেই সূত্রে তিন বছর ধরে ছেলের সঙ্গে কথাও বলেননি। রাহুল বর্তমানে মায়ের সঙ্গে দেহরাদূনে থাকেন। এ দিন নিজেদের মধ্যে নীরবতা ভেঙেছেন বাবা-ছেলে।

কেন পিটার বিশ্বাস করলেন না ছেলেকে? পিটারের দাবি, স্ত্রীর উপরে অগাধ বিশ্বাস ছিল তাঁর। শিনাও ইন্দ্রাণীর সঙ্গে বোনের মতোই ব্যবহার করতেন। ইন্দ্রাণী তাঁর অসমের পরিবার নিয়ে কখনও কিছু জানাননি? পিটার বলেন, ‘‘আমি শুনেছিলাম তেজপুরে ওদের পৈতৃক চা বাগান আছে। গুয়াহাটিতে বাড়ি। কিন্তু আমি কখনও সেখানে যাইনি, স্ত্রীর কথায় সন্দেহও করিনি।’’

তা হলে কী ভাবে সামনে এল সব? গত ২১ অগস্ট একটি বেআইনি অস্ত্র মামলায় ইন্দ্রাণীর প্রাক্তন গাড়িচালক শ্যাম মনোহর রাই নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে মুম্বই পুলিশ। ধৃত জেরায় একটি পুরনো খুনের কথা স্বীকার করে। জানায়, তিন বছর আগে, ২০১২ সালের২৪ এপ্রিল একটি মেয়েকে খুন করে রায়গড়ের পেন তালুকের কাছে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে শ্বাসরোধ করে মেরে তার পর পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেহ। মুম্বই পুলিশ জানাচ্ছে, প্রথমে মনোহরের কথা বিশ্বাস করেনি তারা। কিন্তু পরে তাদের মনে পড়ে, খার থানায় তিন বছরের পুরনো একটি নিখোঁজ ডায়েরির কথা। মনে পড়ে, ২০১২ সালের ২৩ মে পেন থানায় একটি অ়জ্ঞাতকুলশীল দেহ উদ্ধারের কথাও।

মনোহরকে সঙ্গে নিয়ে রায়গড়ের ঘটনাস্থলে যায় পুলিশের একটি দল। সেখানে মাটির তলা থেকে কিছু দেহাংশ উদ্ধার হয়। এবং সেই সঙ্গেই বেরিয়ে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। মনোহর জানায়, ইন্দ্রাণীর কথা মতোই মেয়েটিকে হত্যা করা হয়। হত্যার সময় উপস্থিত ছিলেন ইন্দ্রাণী এবং প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব।

কেন নিজের সন্তানকে খুন করলেন ইন্দ্রাণী? উত্তর মেলেনি এখনও। পুলিশ জানতে পেরেছে সম্পত্তি সংক্রান্ত কিছু জরুরি কাগজ ছিল শিনার কাছে। সেই নিয়ে বিবাদ হয়ে থাকতে পারে। ২০০৭ সালে পিটার এবং ইন্দ্রাণী নাইনএক্স নামে একটি টিভি সংস্থা খুলেছিলেন। সেখানকার অর্থনৈতিক লেনদেন এই খুনের সঙ্গে জড়িত কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পিটারের দাদা গৌতম মুখোপাধ্যায়কেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে ডেকে পাঠাচ্ছে মুম্বই পুলিশ। শিনার ভাই মিখাইল অবশ্য দাবি করছেন, সম্পত্তি নয়, হত্যার কারণ অন্য কিছু। সেটা কী, তিনি যথাসময়ে জানাবেন।

পিটারের ছেলে রাহুলের সঙ্গে শিনার সম্পর্কই কি সেই কারণ? তদন্ত করে দেখা হচ্ছে তা-ও। পিটার নিজে বলছেন, শিনা-রাহুলের সম্পর্ক মেনে নেননি ইন্দ্রাণী। আবার শিনা-মিখাইলের প্রকৃত পরিচয়ও গোপন করেছিলেন পিটারের কাছে। রাহুলের সঙ্গে শিনার ঘনিষ্ঠতা সেই মিথ্যা ফাঁস করে দেবে, এমন ভয়ই কি ইন্দ্রাণীকে মরিয়া করে তুলল? নাকি ইন্দ্রাণীর বর্ণময় জীবন নিয়ে তাঁকে ব্ল্যাকমেল করছিলেন শিনা? তদন্তকারীরা সব সম্ভাবনাই মাথায় রাখছেন।

কিন্তু প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব কেন জড়ালেন এই খুনে? স্পষ্ট নয়। তবে পুলিশের দাবি, মেয়েকে পৃথিবী থেকে হটাতে এই সঞ্জীবের সঙ্গেই পরিকল্পনা করেছিলেন ইন্দ্রাণী। তিনিই জেরার মুখে সঞ্জীবের নাম বলেন। সঞ্জীব কবে এলেন ইন্দ্রাণীর জীবনে? অসমে বরা পরিবার ও প্রতিবেশীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী। পরে বাবা-মা তাঁকে ফেরত এনে শিলং-এর কলেজে পাঠান। সেখানে সিদ্ধার্থ দাসের সঙ্গে ইন্দ্রাণীর প্রেম হয়। ঘরোয়া ভাবে বিয়েও হয়। তাঁদেরই সন্তান মিখাইল ও শিনা। সিদ্ধার্থকে ব্যবসার জন্য টাকা দেন ইন্দ্রাণীর বাবা। সেই সূত্রে ত্রিপুরায় সিদ্ধার্থ চা বাগান কিনেছিলেন। কিন্তু পরে ইন্দ্রাণী সিদ্ধার্থ ও দুই সন্তানকে ফেলে সিদ্ধার্থর ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতায় পালিয়ে যান। সেখানেই তাঁর আলাপ হয় সঞ্জীবের সঙ্গে। তাঁদের বিয়ে হয়। সঞ্জীব ও ইন্দ্রাণীর একটি মেয়ে রয়েছে, তার নাম বিধি। এর কিছু দিন পরে সঞ্জীবের সঙ্গে ছা়ড়াছাড়ি হয়। ইন্দ্রাণী মুম্বই চলে যান।

মুম্বইয়ে স্টার ইন্ডিয়ার তৎকালীন কর্তা পিটারের সঙ্গে দেখা হয় ইন্দ্রাণীর। একটি নামী সংস্থায় তখন কর্মরত তিনি। দু’জনের আলাপ করিয়ে দেন বিজ্ঞাপন জগতের গুরু অ্যালেক পদমসি। পিটার তখন বিবাহবিচ্ছিন্ন। তবে জনৈকা শাশ্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বাগদান হয়ে ছিল। সেটা ভেঙেই ৩০ বছর বয়সী ইন্দ্রাণীকে বিয়ে করেন ৪৬ বছরের পিটার। এ দিন শাশ্বতীর ভাই বলেন, ‘‘ওরা আমার বোনের জীবন নষ্ট করেছে। ওদের নিয়ে কথা বলতে চাই না।’’

বিয়ের ৫ বছরের মাথায় নিজেদের সংস্থা তৈরি করেন পিটার-ইন্দ্রাণী। দু’বছর পরে, ২০০৯ সালে অবশ্য সেটা ছেড়েও বেরিয়ে যান তাঁরা। ইতিমধ্যে ইন্দ্রাণীর বোন পরিচয়ে শিনা মুম্বই গিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। ঢুকেছেন চাকরিতেও। প্রথমে অসমের একটি ছেলের সঙ্গে শিনার সম্পর্ক ছিল। পরে রাহুলের সঙ্গে সম্পর্ক হয়। যে সংস্থায় কাজ করতেন শিনা, ২০১২-র ২৪ এপ্রিল সেখানে ছুটির দরখাস্ত করেছিলেন। ওই দিনই খুন হয় যান। অথচ কে বা কারা কিছু দিন পরে শিনার ই-মেল ব্যবহার করে চাকরিতে পদত্যাগপত্র পাঠায়। কে ব্যবহার করল শিনা-র মেল, খুঁজছে পুলিশ।

এ দিন কলকাতায় বেলভেডিয়ার রোড থেকে ধরা হয় সঞ্জীবকে। প্রথমে হেস্টিংসে সঞ্জীবের বাড়িতে হানা দেয় মুম্বই পুলিশ। জানা যায়, আলিপুরে বন্ধুর বাড়িতে রয়েছেন তিনি। সেখান থেকে ধরা হয় তাঁকে। সঞ্জীবের বন্ধু অজয় রাওলা বলেন, ‘‘ইন্দ্রাণীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও যোগাযোগ ছিল সঞ্জীবের।’’ বৃহস্পতিবার সঞ্জীবকে আলিপুর আদালতে তোলার পরে নিয়ে যাওয়া হবে মুম্বই। মঙ্গলবার ওরলির বাড়ি থেকে ইন্দ্রাণীকে থানায় ডেকে তিন ঘণ্টা জেরা করা হয়। খুনের কথা স্বীকার করেন। কিন্তু তখনও বলেননি, শিনা তাঁর মেয়ে। গ্রেফতার হওয়ার পরে শিনাকে নিজের সন্তান বলে স্বীকার করে নেন। মায়ের হাতে মেয়ে খুনের মতো বিরল মামলার সাক্ষী হয়েই শিহরণ ছড়িয়েছে দেশ জুড়ে। এর আগে সন্তান-হত্যার ঘটনায় সাধারণত অনার-কিলিং বা পারিবারিক মর্যাদা রক্ষার তাড়নাই বেশি করে সামনে এসেছে। আরুষি তলোয়ার হত্যায় বাবা-মায়ের সাজাও সেই গোত্রেই পড়ে। পঞ্জাবের পুষ্পা কোহলি বা লন্ডনে পলি চৌধুরির মতো দু’একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ছাড়া কন্যাঘাতী মায়ের দেখা পাওয়া যায়নি তেমন ভাবে। কুসন্তান যদি বা হয়, কুমাতা কখনও নয়— প্রবাদটির সত্যতা নিয়েই যেন প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল শিনা বরা-র হত্যা রহস্য।

Sheena Peter Mukerjea Mikhail Bora Indrani mukherja star india ceo abpnewsletters MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy