কান্নায় ভেঙে পড়া মুখ্যমন্ত্রী পনীরসেলভমকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশে শশিকলা নটরাজন। মঙ্গলবার চেন্নাইয়ের রাজাজি হলে। ছবি :পিটিআই।
শেষ বার এমনটা হয়েছিল ঠিক উনত্রিশ বছর আগে। দক্ষিণ ভারতের এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করতে একসঙ্গে উপস্থিত হয়েছিলেন স্বয়ং দেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী। ১৯৮৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর মারা গিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এমজিআর— মারুদুর গোপালন রামচন্দ্রন। এডিএমকে প্রধানের ক্যারিশমাই এমন ছিল যে, তাঁর শেষকৃত্যে হাজির ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আর বেঙ্কটরামন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী।
২০১৬-র এক ডিসেম্বরের দুপুরে উনত্রিশ বছর আগের ছবিটাই যেন ফিরে এল। সেই তামিলনাড়ুরই মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণের পর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে চেন্নাই উড়ে এলেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। ঘটনাচক্রে যাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার এমজিআরের হাতেই গড়া। আজ বিকেলে এডিএমকে নেত্রী জে জয়ললিতার শেষকৃত্য সম্পন্ন হল চেন্নাইয়ের মেরিনা সৈকতে। দাহ নয়, ‘গুরু’র মতোই সমাহিত করা হলো তাঁকে। চন্দনকাঠের কফিনে। এমজিআরের স্মৃতিসৌধের ঠিক পাশেই শায়িত থাকবেন ‘আম্মা’।
সবুজ রং প্রিয় ছিল জয়ললিতার। তাঁর জন্য আজ ওই রংটাই বেছেছিলেন তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী শশিকলা নটরাজন। জয়াকে পরিয়েছিলেন মেরুন পাড় গাঢ় সবুজ কাঞ্জিভরম। কপালে ছোট্ট লাল টিপ। হাতে সরু চুড়ি। শরীর জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢাকা। আজ ভোরেই পোয়েজ গার্ডেনের বাড়ি থেকে রাজাজি হলে আনা হয় দেহ। তার পর থেকে শুধু বাঁধভাঙা চোখের জল আর লাখ লাখ মানুষের স্রোত দেখেছে রাজাজি হল।
জয়ললিতার উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। - নিজস্ব চিত্র
এর আগে এত হাই প্রোফাইল শেষকৃত্য অনুষ্ঠান দেখেছে কি চেন্নাই? এক দিকে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অন্য দিকে রজনীকান্ত, বৈজয়ন্তীমালার মতো তারকারা। মানুষের ভিড়ের মধ্যে ভিভিআইপিদের সামলাতে হিমশিম খেয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। আজ দুপুরে রাজাজি হলে পৌঁছন নরেন্দ্র মোদী। তাঁকে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সদ্য নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী পনীরসেলভম। তাঁর পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও তাঁকে জড়িয়ে ধরে আর এক প্রস্ত কান্নাকাটি করেন তিনি। মোদীকে দেখে চোখের জল সামলাতে পারেননি জয়ার দেহের পাশে সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা শশিকলাও। বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পৌঁছতে খানিকটা দেরি হয়। এসেছিলেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। শোকবার্তা পাঠান সনিয়া গাঁধী। ছিলেন দেশের ন’টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঠিয়েছিলেন দলের দুই সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
কোনও রাজ্যের ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণের পর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির একই সঙ্গে অন্ত্যেষ্টিতে সামিল হওয়ার নজির বিরল। বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে রাষ্ট্রপতি কোনও রাজ্যে যান না। এমজিআরের মৃত্যুর পর বেঙ্কটরামন তাঁর শেষকৃত্যে সামিল হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি নিজে তামিলনাড়ুর মানুষ ছিলেন বলেই এমনটা করেন বলে অনেকের ব্যাখ্যা। তা হলে আজ রাষ্ট্রপতি চেন্নাই এলেন কেন? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে বলা হয়েছে, জয়ললিতার মৃত্যুতে যে হেতু জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে, তাই প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানাতে তামিলনাড়ু যান প্রণববাবু।
বিকেল সাড়ে চারটেয় রাজাজি হল থেকে শুরু হয় শেষযাত্রা। গন্তব্য মেরিনা সৈকত। দু’টন ফুল দিয়ে সাজানো সেনার ট্রাকে তাঁর দেহ যখন তোলা হচ্ছে, দিনের আলো পড়তে শুরু করেছে। আজ শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ছিল সেনা। কাচ দিয়ে ঢাকা শববাহী গাড়িটা যখন সৈকতের দিকে এগোচ্ছে, দু’ধারে অজস্র মানুষ। মুখে ‘আম্মা ভাজঘা’ (অমর রহে আম্মা) ধ্বনি। কনভয়ের সামনে হেঁটেছেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তিন কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতেই লেগে যায় এক ঘণ্টা।
২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮: মহীশূরে জন্ম
১৯৫০: বাবার মৃত্যু। ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রথমে বেঙ্গালুরু, পরে চেন্নাই চলে এলেন মা
১৯৬১: অভিনয় জগতে পা। প্রথম ছবি ইংরেজিতে— ‘এপিসল’
১৯৬৪: সরকারি বৃত্তি পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ
১৯৬০-১৯৮০: এম জি রামচন্দ্রনের সঙ্গে অসংখ্য ছবি
১৯৮২: এমজিআর-এর হাত ধরে রাজনীতিতে
১৯৮৭: এমজিআরের মৃত্যু
১৯৮৯: দলের নেত্রী
১৯৯১: কনিষ্ঠতম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ
২০০১, ’০২, ’১১: আরও তিন বার মুখ্যমন্ত্রী
২০১৪: আয় বহির্ভূত সম্মতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত। মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরলেন
২০১৫: নির্দোষ, রায় কর্নাটক হাইকোর্টের। পঞ্চম বার মুখ্যমন্ত্রী
২০১৬: ষষ্ঠ বার মুখ্যমন্ত্রী
সেপ্টেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি, লড়াই থামল আড়াই মাস পর
মেরিনা সৈকতে পৌঁছনোর পরে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শ্রদ্ধা জানানো হয় জয়ললিতাকে। সেখানে তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল, প্রাক্তন রাজ্যপাল-সহ জয়ললিতার দলের বেশ কিছু নেতা গোলাপ পাপড়ি দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তাঁকে। আসেন রাহুল গাঁধীও।
তার পর ধর্মীয় রীতি মেনে চলে শেষ আচার। প্রয়াত নেত্রীর এক ভাইপো, দীপক আর বন্ধু শশিকলাই পুরোহিতের পরামর্শ মতো সেই কাজটুকু সারেন। তার পর সরিয়ে নেওয়া হয় জাতীয় পতাকা। চন্দনকাঠের কফিনে ঢাকা হয় দেহ। ধীরে ধীরে পোঁতা হয় পেরেক। গর্তের মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হয় কফিন। এই শেষ পর্বটুকু নিয়ে বিতর্কও হয়েছে যথেষ্ট। শেষ সময় আম্মার আত্মীয়েরা কেন তাঁর পাশে নেই, সেই প্রশ্নও বারবার উঠেছে।
ভিড় সামলানোর কাজে আজ গোটা দেশের বাহবা কুড়িয়েছে চেন্নাই পুলিশ। তবে প্রিয় নেত্রীর মৃত্যুর শোক সামলাতে না পারায় মৃত্যু হয়েছে রাজ্যের তিন জনের। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন দু’জন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy