ভোটের মরসুম বলে ছাড়! নাকি একেবারে কৌশলগত পশ্চাদপসরণ?
সিপিএমের ২১তম পার্টি কংগ্রেস উদ্বোধন করতে গিয়ে বাংলায় দলের জনভিত্তি হারিয়ে ফেলা এবং সাংগঠনিক দুরবস্থা সম্পর্কে সমালোচনা মুলতবি রেখে দিলেন প্রকাশ কারাট! দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর শেষ পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধনী মঞ্চকে তিনি বরং অনেক বেশি করে ব্যবহার করলেন বাংলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত দলীয় সৈনিকদের জন্য। সর্বভারতীয় মঞ্চে মানস মুখোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো জেলা নেতাদের নাম তুলে রাজ্য সিপিএমের জন্য সহমর্মিতার বার্তা দিলেন।
অথচ মাত্র এক মাস আগেই কলকাতায় দলের রাজ্য সম্মেলনের উদ্বোধন করতে গিয়ে এই প্রকাশ কারাটই বলেছিলেন, শুধু ৩৪ বছরের সরকার চলে যাওয়া নয়, পশ্চিমবঙ্গে দলের জনভিত্তিতেও ধস নেমেছে। যা ভোটে হারের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক। ক্ষমতা হারালেও বামেদের আর এক শক্ত ঘাঁটি কেরলে এমন ঘটেনি বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পার্টি কংগ্রেসে এসে সেই কারাটই মঙ্গলবার সুর কিছুটা বদল করে বললেন, ‘‘সাম্প্রতিক কালে বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তথা বামেদের যে ধাক্কা খেতে হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতেই হবে। তৃণমূলের সন্ত্রাস মোকাবিলা করে আমাদের দল এবং বামেদের যে হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক সাহসের সঙ্গে আন্দোলন করছেন, এই মঞ্চ থেকে তাঁদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।’’ যে কথার মধ্যে উদ্বেগ বা সমালোচনার চেয়ে উদ্বুদ্ধ করার বার্তাই বেশি। বাংলায় গিয়ে কড়া কথা বলে এসে বাংলা থেকে দূরে অন্ধ্রপ্রদেশে দাঁড়িয়ে সেই পথে কেন হাঁটলেন না সিপিএমের বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক?
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘বাংলায় এখন পুরভোট। দলের কর্মী-সমর্থকেরা শাসক দলের আক্রমণ মোকাবিলা করে হারানো জমি ফিরে পাওয়ার লড়াই চালাচ্ছেন। গত এক মাসে ধারাবাহিক ভাবে দল ও গণসংগঠনগুলি পথে নেমেছে। এই সময়ে সংগঠনের সমালোচনার বদলে তাদের উত্সাহ দেওয়াই বেশি দরকার ছিল।’’ বস্তুত, গোটা দেশ থেকে আসা ৭৪৯ জন প্রতিনিধি, ৭২ জন পর্যবেক্ষক এবং ৭ জন বিশেষ আমন্ত্রিতের সামনে এ দিন বাংলার পুরভোটের প্রসঙ্গ সরাসরি এনেও দিয়েছেন কারাট। বলেছেন, ‘‘কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে পুরভোটের জন্য আমাদের অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধি এখানে আসতে পারেননি। আমাদের দুই কমরেড, মানস মুখোপাধ্যায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় ভোট না থাকলে পার্টি কংগ্রেসে আসতেন। নির্বাচনী প্রচারের সময়ই আক্রান্ত হয়ে তাঁদের হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। এই পার্টি কংগ্রেস তাঁদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দ্রুত আরোগ্য কামনা করছে।’’ বিশাখাপত্তনমের পোর্ট স্টেডিয়ামের মধ্যে নবনির্মিত কলাবাণী হল জুড়ে তখন হাততালির ঝড়।
সিপিএমের মধ্যেই একাংশ অবশ্য বলছে, পুরভোটের বালাই তো আছেই। তার সঙ্গে নতুন সাধারণ সম্পাদক এবং কমিটি নির্বাচনের অঙ্কও বাংলার দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে এক রকম ‘বাধ্য’ করেছে কারাটকে! কারণ তিনি বিলক্ষণ জানেন, সাংগঠনিক ভাবে কোণঠাসা হলেও সর্বভারতীয় স্তরে সিপিএমের নেতৃত্ব নির্বাচনে বাংলা ব্রিগেডের ভূমিকা এখনও উল্লেখযোগ্য। তাই পার্টি কংগ্রেসের গোড়াতেই বঙ্গ ব্রিগেডের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে চাননি। কারাট যদি তাঁর পছন্দের এস রামচন্দ্রন পিল্লাইকেই সম্পাদক করতে চান, সেখানে বাংলার ভূমিকা ফেলে দেওয়ার নয়!
উদ্বোধনী-পর্বে নরম থাকার পাশাপাশিই পার্টি কংগ্রেসে পেশ হওয়া দলের খসড়া সাংগঠনিক রিপোর্টও এ বার বাংলার প্রতি খুব নির্দয় নয়! এমনিতেই সাংগঠনিক বিষয়ে কয়েক মাসের মধ্যে আলাদা প্লেনাম হবে বলে পার্টি কংগ্রেসে এ বারের সাংগঠনিক রিপোর্ট খুব বিশদ নয়। সেখানে দেখানো হয়েছে, গত তিন বছরে বাংলায় সিপিএমের সদস্য কমেছে ৩৯ হাজার ৯৬৮ জন। রাজ্যে দলের অনেক ইউনিট এখনও পঙ্গু, বেশ কিছু জায়গায় নিষ্ক্রিয়তার সমস্যা রয়েছে। তবে বাংলায় যে বিশেষ পরিস্থিতির মোকাবিলা করে এগোতে হচ্ছে, সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। বাংলা ছাড়া সিপিএমের জন্য বড় রাজ্য বলতে অন্ধ্রপ্রদেশেও সদস্য কমেছে। আরও কিছু ছোট রাজ্যও কমতির তালিকায়। কিন্তু সেখানে সদস্যসংখ্যাই মোটের উপর কম বলে ধাক্কা খুব বেশি নয়। উল্টো দিকে, কেরলে ৩৪ হাজার ৬৯২, তামিলনাড়ুতে ১০ হাজার ৫৭৯ এবং ত্রিপুরায় ৮ হাজার ৯৫৩ জন সদস্য বেড়েছে। যোগ-বিয়োগে দেখা যাচ্ছে, গোটা দেশে সিপিএমের কলেবর তিন বছরে প্রায় ১৫ হাজার বেড়েছে! এই বিপর্যয়ের বাজারেও এমন তথ্য বিদায়লগ্নে একটু স্বস্তি দিচ্ছে কারাটকে।
সদস্যসংখ্যার বিচারে বাংলা যেখানেই থাকুক, সমুদ্র-শহরে আমন্ত্রিত হয়ে এসে অন্য বাম দলের নেতারাও কিন্তু আলিমুদ্দিনের লড়াইয়ের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক সুধাকর রেড্ডি যেমন পরিষ্কারই বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের আক্রমণের প্রথম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সিপিএম। আমরা আপনাদের পাশে আছি। বাংলায় তৃণমূল আর বিজেপি-কে এক সঙ্গে পরাস্ত করতে হবে মিলিত ভাবেই।’’ ফরওয়ার্ড ব্লকের দেবব্রত বিশ্বাস বলেছেন, ‘‘মারের মুখে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হচ্ছে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদের। তাঁদের দিশা দেখাতে হবে।’’ সহমর্মিতার বার্তা দিতে ভোলেননি এসইউসি-র সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষও।
আর এ সবের মধ্যে বসে দূরে থেকেও সিপিএমের বঙ্গ ব্রিগেড নজর রেখে চলেছে বাংলায় পুরভোটের ময়দানে। পার্টি কংগ্রেসের জন্য বাছাই হওয়া ১৭৫ জন প্রতিনিধির মধ্যে জনা পঞ্চাশ ভোটের জন্য শেষ পর্যন্ত বিশাখাপত্তনমে আসেননি। পার্টি কংগ্রেসে আসার পথে ভুবনেশ্বরে উড়ান-বিরতির ফাঁকেও রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রকে খোঁজ নিতে হয়েছে কর্মীদের উপরে হামলার। আর বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু ভিন্ রাজ্যের পলিটব্যুরো সদস্যকে বলেছেন, ‘‘তেমন পরিস্থিতি হলে কিন্তু ফিরে যেতে হবে আমাদের!’’
পুরভোটের উত্তাপ যেন বঙ্গোপসাগর বরাবর নেমে এসেছে অন্ধ্র উপকূলেও!