সুনসান মঞ্চ। বিধানসভার ফল ঘোষণার পর এখানেই সাংবাদিক বৈঠক করার কথা ছিল বিজেপি নেতৃত্বের। নয়াদিল্লিতে এপির ছবি।
কেজরী-ঝড়ে কুপোকাত দল! অশোক রোডে সদর দফতর বেলা গড়াতেই সুনসান। যে দু’-এক জন আছেন, তাঁদের ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস আর টিভির মৃদু আওয়াজ ছাড়া কোনও শব্দই নেই! বেশি ভাগেরই চোখমুখ থমথমে। কিন্তু তার মধ্যেই কান পাতলে শোনা যাচ্ছে মুচকি হাসির মৃদু স্বর! ভেসে আসছে চাপা ক্ষোভের গুঞ্জনও।
ন’মাস হল পাকাপাকি ভাবে নরেন্দ্র মোদী-যুগ শুরু হয়ে গিয়েছে বিজেপিতে। তার পর থেকে যেন অদৃশ্য ফতোয়া চলছে দলে। কেউ মুখ খুলবেন না। লালকৃষ্ণ আডবাণী-মুরলী মনোহর জোশীর মতো প্রবীণ নেতারা ব্রাত্য হলেও মুখ বন্ধ রাখবেন। কিন্তু তার পরেও খোদ রাজধানীতেই ঝাড়ু-ঝড়ে দল প্রায় উড়ে গেল! বিজেপিতে মোদী-অমিত শাহ যুগ শুরু হওয়ার পরে প্রথম বার। দলের অনেক নেতা যেন এমনই একটি সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। এখনই প্রকাশ্যে না হলেও দলের অন্দরে তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, জিতলে তো এতক্ষণে ঢাকঢোল পিটিয়ে মোদীর জয়ধ্বনি হতো! মোদীর তরফে আরও একটি ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’-এর শিরোপা জুটে যেত অমিত শাহের! তা হলে এখন কেন দায় নেবে না এই জুটি?
আডবাণীই হোন বা সুষমা স্বরাজ, দিল্লি বিজেপির সভাপতি সতীশ উপাধ্যায় হোন বা ২০১৩ সালের ভোটে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হর্ষবর্ধন ঘরোয়া স্তরে অনেকেই এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। এমনই এক নেতা আজ বলেন, “এ তো কংগ্রেসের গাঁধী পরিবারের ঘরানা! জিতলে সনিয়া-রাহুলের কৃতিত্ব, হারলে দলের ভুল! দিল্লিতে হারের দায় কেন মোদী ও অমিত শাহ নেবেন না? যখন পুরনোদের বাদ দিয়ে কিরণ বেদীকে আনা থেকে দলের যাবতীয় কৌশল তৈরি সবই একতরফা ভাবে ঠিক করেছেন দু’জনে!” একই সঙ্গে তাঁদের ক্ষোভ, শেষ দিকে দিল্লি বিজেপির পুরো রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন অমিত শাহ। ঘরোয়া স্তরে এ সব বললেও এই নেতারা জানেন, এখনই প্রকাশ্যে আওয়াজ তোলার সময় আসেনি। তবে বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে নিয়ে ঘোঁট পাকানো অন্তত শুরু হয়ে গেল বিজেপিতে!
অবশ্য শুধু দলের অন্দরে নয়, শরিকদের বাঁকা হাসিও হজম করতে হচ্ছে বিজেপিকে! দিল্লিতে বিজেপির বিপর্যয়ের পরে মহারাষ্ট্রে দলের শরিক শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে আজ শুধু যে কেজরীবালকে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর শপথে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তা-ই নয়। দেশজুড়ে মোদী-ঢেউ নিয়ে বিজেপির প্রচারকে কটাক্ষ করে উদ্ধব বলেন, “দিল্লির জনতা দেখিয়ে দিলেন, ঢেউয়ের থেকে সুনামির শক্তি বেশি!”
ভোটের আগে থেকেই বিজেপির অন্দরে বিক্ষোভের আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল। লোকসভা ভোটের পর এই প্রথম বার প্রকাশ্যে মোদী-শাহের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছিল দিল্লিতে! দলের দফতরে মোদী-অমিতের পোস্টারও ছেঁড়া হয়। দিল্লির বিজেপি নেতা জগদীশ মুখী প্রকাশ্যেই বলেন, কিরণ বেদীকে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আলোচনা হয়নি। প্রায় একই কথা আজ বলেছেন দলের মুখপাত্র শাহনওয়াজ হোসেন। তিনি বলেন, “দলের নেতৃত্ব কিরণ বেদীকে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা আগে জানতাম না।” এমনকী কিরণও আজ ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেন, তিনি হারেননি, তাঁকে হারানো হয়েছে! কিরণ যে কৃষ্ণনগর আসন থেকে হেরেছেন, ১৯৯৩ সাল থেকে সেটি বিজেপি নেতা হর্ষবর্ধনের জেতা আসন। সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া প্রাক্তন এই আইপিএস যেটি প্রকাশ্যে বলতে পারেননি, সেটিই স্পষ্ট করে বলেছেন তাঁর স্বামী ব্রিজ বেদী। তিনি বলেন, “যে কৃষ্ণনগর আসন থেকে কিরণ বেদী লড়েছেন, সেটি হর্ষবর্ধনের বড় ব্যবধানে জেতা আসন। কিরণ হেরেছেন মানে দলের কর্মীরা তাঁর হয়ে কাজ করেননি!”
দিল্লি বিজেপির অন্তর্কলহ অবশ্য নতুন নয়। নব্বই-এর দশকের শেষ দিকে যখন বিজেপি শেষ বার দিল্লিতে ক্ষমতায় আসে, তখন সাহিব সিংহ বর্মা ও মদনলাল খুরানা গোষ্ঠীর ঝগড়া থামাতে সুষমা স্বরাজকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। গত নির্বাচনে বিজয় গোয়েল ও বিজয় কুমার মলহোত্রর ঝগড়ার কারণে হর্ষবর্ধনকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরে ভোটে লড়ে বিজেপি। এ বারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় হর্ষবর্ধনকে স্বাস্থ্য থেকে সরিয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মন্ত্রকে পাঠানোর পরে এই বার্তা যায়, তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী পদের মুখ করা হবে। কিন্তু এ নিয়ে ঐকমত্য হয়নি।
কিরণ বেদীকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার কারণ হিসেবে অমিত-ঘনিষ্ঠ নেতারা এই অন্তর্কলহের যুক্তিকেই বড় করে দেখাচ্ছেন। কিন্তু কিরণ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার দিন থেকেই যে রকম আচরণ করতে শুরু করেন, তাতে আরও ক্ষুব্ধ হন দিল্লি নেতারা। তা চাপাও থাকেনি। ফলে বহু জায়গাতেই অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিজেপি নেতৃত্ব। অনেকেই বলছেন, যে ভাবে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ডে কাউকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে না ধরেই ভোটে গিয়েছে দল, এ বারেও তেমন করলে কী অসুবিধা হতো? এই নেতাদের বক্তব্য, মোদী-অমিতই তো একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের নেতাদের ক্ষোভ বাড়িয়ে তুললেন! তার পর নেতারা আর মন দিয়ে কাজ করবেন কী করে? সব মিলিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে, বিজেপির বহু নেতা চাইছিলেন, দল হেরে যাক এবং মোদীর বিজয়রথে লাগাম পড়ুক। যাতে দলে মোদী-অমিতের একাধিপত্য লঘু হয়।
বিজেপির এক বিক্ষুব্ধ নেতা মুচকি হেসে বলেন, “মোদী, অমিতের বোঝা উচিত, এটা গুজরাত নয়, দিল্লি! মুষ্টিমেয় কয়েক জনকে নিয়ে সব সিদ্ধান্ত নিলে চলে না।” তাঁর মতে, গত ন’মাসে মোদী বহু প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। এর দায় নিতে হবে শীর্ষ দুই নেতাকেই। ফলে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়ে আসন বাড়ানোর যে সুযোগ ছিল, তা-ও হারিয়েছে বিজেপি। সেই ভোট চলে গিয়েছে কেজরীবালের বাক্সে!
বাকিটা ইতিহাস!
উঠলে নামতেই হয়, মোদীকে কটাক্ষ চ্যানেলের
সংবাদ সংস্থা • ওয়াশিংটন ও লন্ডন
পদার্থবিদ্যার তত্ত্বই বলছে, যা উপরে ওঠে, তাকে নেমে আসতেই হয়। দিল্লি বিধানসভা ভোটে বিজেপির শোচনীয় ফল নিয়ে এ ভাবেই কটাক্ষ করেছে আমেরিকার একটি প্রথম সারির টিভি চ্যানেল। অন্য একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমের মতে, এটা ছোটখাটো রাজনৈতিক ভূমিকম্প।
দিল্লি বিধানসভা ভোটের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক মর্যাদা যে জড়িয়ে গিয়েছে তা বুঝেছিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। অরবিন্দ কেজরীবালের আম আদমি পার্টির (আপ) বিপুল জয়ের পরে তাই মোদীর রাজনীতি নিয়েই চর্চা করেছে তারা। একটি মার্কিন চ্যানেলের কটাক্ষ, “নয়াদিল্লিতে বিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব নিয়ে এখন আলোচনা হবে। যা উপরে ওঠে, তাকে নেমে আসতেই হয়। সাধারণ নির্বাচন ও কয়েকটি রাজ্যে বিপুল জয় পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু দিল্লির ভোটে বড় ধাক্কা খেয়েছে।” একটি মার্কিন সংবাদপত্রের মতে, মোদী ক্ষমতায় আসার পরে এক মাসও কাটেনি। তার মধ্যেই দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের এক নেতার নতুন দলের হাতে হেরে গেল তারা।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের মতেও, মোদী বড় ধাক্কা খেয়েছেন। বিদেশি লগ্নিকারী ও বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের ভারতে আমন্ত্রণ করার পরেই মোদী এই ধাক্কা খেলেন বলেও মন্তব্য করেছে তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy